ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলই লক্ষ্য ॥ গুম সমাচার

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলই লক্ষ্য ॥ গুম সমাচার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্যক্তি কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বেই গুম হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ। কোন কোন গুমের পেছনে রয়েছে পারিবারিক সঙ্কট। বিশেষ কোন ঘটনা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর লক্ষ্যেও সাজানো হয় গুমের ঘটনা। কিছু ঘটনার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থাকলেও সকল গুমেরই প্রাথমিক দোষ চাপানো হয় এই বাহিনীর ওপর। অধিকাংশ গুমের নেপথ্য ঘটনাই পরে উদ্ঘাটিত হয়। কিছু ঘটনার রহস্য কোন দিনই জানা যায় না। ঘটনার পেছনে যাই থাকুক আমাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিলে গুমের মতো নেতিবাচক শব্দটির ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে-বিদেশে সামাজিক ও কূটনৈতিকভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হদিসহীন ব্যক্তি গুম হয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হয়। মূলত ইস্যু তৈরি করতেই হালে ব্যাপকভাবে গুম শব্দটির ব্যবহার বেড়েছে। যদিও অপহৃত বা গুম বলে প্রচার করা অনেকেরই হদিস মিলেছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। তার পরও হদিসহীনদের গুম বা অপহরণ করার অভিযোগ থেকে সরকার ও সরকারী বাহিনী পরিত্রাণ পাচ্ছে না। ছোট ছোট অপহরণকারী দলও অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। বেশিরভাগ অপহরণ মামলার তদন্তেই রাজনৈতিক মাঠ গরম করতে বা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য বা স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে সরকারের ঘাড়ে অপহরণ বা গুমের অভিযোগ চাপিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে বলে তথ্য মিলেছে। হালে এত অপহরণের অভিযোগের পরেও বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের অপহরণের রেকর্ড ভাঙ্গেনি। দীর্ঘ অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। বহুল আলোচিত গুম ॥ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন সিলেটের বিশিষ্ট চিকিৎসক মেজর (অব) রুকন উদ্দিন চৌধুরী। সেনাসদস্য নিখোঁজের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আজও তাঁর হদিস জানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ২০০৪ সালে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন অপহৃত হন। দীর্ঘ সময় পর তাঁর কঙ্গাল উদ্ধার হয় চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গল থেকে। পরে এই গুমের সঙ্গে জড়িত বলে তৎকালীন বিএনপির এক সংসদ সদস্যের নাম উঠে আসে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকেই এই গুম হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ৫ বছর জেল খেটে ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেন। কারামুক্ত হয়েই মাদারীপুর থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে জনসংযোগ শুরু করেন। ওই বছরই ২৬ নবেম্বর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের ৪০৫ নম্বর বাড়ির সাউথ প্রাইড এ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলার এ/৩ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আজও হদিস মেলেনি। বহুল আলোচিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম ২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হন। রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারযোগে ধানমন্ডি যাওয়ার উদ্দেশে বের হন। ফার্মগেট থেকে সাদা পোশাকধারী একদল ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় বলে শেরেবাংলা নগর থানায় পরিবারের তরফ থেকে দায়েরকৃত মামলার অভিযোগে বলা হয়। পরবর্তীতে চৌধুরী আলমের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজার ওয়াসা ভবনের কাছ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়। আজও তাঁর হদিস মেলেনি। ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল চালক আনসার আলীসহ ইলিয়াস আলী রাজধানী ঢাকার বনানী আমতলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শওকত নামে ইলিয়াস আলীর এক ঘনিষ্ঠ ক্যাডার সিলেটে খুন হন। খুন হওয়া শওকত ও খুনী ইফতেখার আহমেদ দিনার দু’জনই ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ। শওকত খুনের সূত্র ধরে ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন দিনার। অদ্যাবধি দিনারের হদিস মেলেনি। দিনার নিখোঁজ হওয়ার সূত্র ধরে সিলেটের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করলে গত বছরের ১৪ এপ্রিল ইলিয়াস আলী সিলেট যান। সেখানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ১৭ এপ্রিল দুপুর ৩টায় বিমানযোগে ঢাকায় পৌঁছেন। ঢাকায় ফিরে বনানীর ২/১ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর ছয়তলা আলিশান নিজ বাড়িতেই দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাঁটান। রাত পৌনে ১০টার দিকে চালক আনসার আলীকে সঙ্গে নিয়ে স্ত্রী তাহ্সিনা রুশদীর লুনার প্রাইভেটকার নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। বের হওয়ার সময় বাড়ির সামনে ২টি মোটরসাইকেলে ৫ যুবদল নেতা অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের ৩ জনকে গাড়িতে তুলে নেন। তাঁরা চলে যান হোটেল রূপসী বাংলায়। সেখানে বৈঠক শেষে রাত ১২টার পর বাসার উদ্দেশে রওনা হন। বনানী ২ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়ির সাউথ পয়েন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের কাছাকাছি পৌঁছলে চালক আনসার আলীসহ ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হন। আজও হদিসহীন চালকসহ ইলিয়াস আলী। ঘটনার পর থেকেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা সরকার র‌্যাব দিয়ে অপহরণের পর চালকসহ ইলিয়াস আলীকে গুম করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন। রাজনৈতিক কারণে অপহরণের পর গুম করা হয় বলেও অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। যদিও র‌্যাব ও সরকারের তরফ থেকে এ সব অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন ও বিএনপির রাজনৈতিক ফায়দা লুটার কৌশল বলে দাবি করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শওকত খুনের ঘটনার সূত্র ধরে ইফতেখার আহমেদ দিনার নিখোঁজ এবং সেই সূত্র ধরে এবং হুন্ডির টাকার সূত্র ধরে চালকসহ ইলিয়াস আলী হদিসহীন হওয়ার ঘটনা ঘটে। নিখোঁজের পর ফেরত আসা বিএনপি নেতাসহ অনেকেই ॥ যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা মজিবর রহমান। চলতি বছরের ৪ মে সুনামগঞ্জ থেকে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারযোগে সিলেট শহরে যাওয়ার সময় চালক রেজাউল হকসহ নিখোঁজ হন বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি মজিবর রহমান। সুনামগঞ্জের টুকেরবাজার বাসস্টেশনের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মজিবর রহমান ও তার চালককে অপহরণ করে বলে পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। এমন ঘটনার পর বিএনপি-জামায়াত জোটের তরফ থেকে সরকার মজিবর রহমানকে ইলিয়াস আলীর মতো চালকসহ গুম করেছে বলে অভিযোগ করে। সরকার একের পর এক বিএনপি নেতাদের গুম করছে বলে বিএনপি-জামায়াত অভিযোগ করে আসছিল। এমন ঘটনায় চলতি বছরের ৬ মে সুনামগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। ৭ মে মানববন্ধন ও ৮ মে সুনামগঞ্জে আধাবেলা হরতাল পালন করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো। ৯ মে মজিবর রহমানের ভাগ্নীজামাতা অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম বাদী হয়ে ৭-৮ জনকে আসামি করে সুনামগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কারণে মজিবর রহমানকে চালকসহ অপহরণ করা হয়েছে বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক মজিবর রহমান অপহরণের ঘটনায় ব্রিটেনে ও বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনে রীতিমতো তোলপাড় চলতে থাকে। লন্ডন প্রবাসী মজিবর রহমানের পরিবারের তরফ থেকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসে ও বাংলাদেশের ব্রিটিশ দূতাবাসে অভিযোগ করা হয়। পরিবারের তরফ থেকে দ্রুত চালকসহ মজিবর রহমানকে উদ্ধারের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বলা হয় সেই অভিযোগে। বাংলাদেশের ব্রিটিশ দূতাবাসের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বিষয়টির অনুসন্ধান করতে সুনামগঞ্জ সফরও করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মজিবর রহমানকে চালকসহ উদ্ধারে অভিযান চালাতে থাকে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে আলী আকবর চৌধুরী, জিহাদুল হক ও তারেকুজ্জামান তারেক, ময়মনসিংহ সদরের শিপশা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লিয়াকত আলী, একই ইউনিয়নের চর শিরতা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম আজাদ এবং সুনামগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কসবা গ্রাম থেকে মাহমুদুর রহমানকে আটক করে পুলিশ। বর্তমানে তারা জামিনে মুক্ত। যেভাবে চালকসহ মজিবর রহমানের হদিস মেলে ॥ গত ১৯ আগস্ট ভোর ৫টার দিকে গাজীপুর জেলার শালনা ব্রিজের কাছে হদিস মেলে চালকসহ মজিবর রহমানের। চালককে এক হাজার টাকা দিয়ে সুনামগঞ্জ পাঠিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিক্যাবযোগে তিনি শ্যালক ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেনের গুলশানের বাড়িতে যান। সেখান থেকে ভর্তি হন রাজধানীর গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে। হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. প্রদীপ রঞ্জন সাহার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। চিকিৎসকরা মজিবর রহমান পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত বলে সাংবাদিকদের জানান। সাড়ে তিন মাস পর মজিবর রহমান ফিরে আসেন। শুধু হাতের কয়েকটি আঙ্গুলে সামান্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। ওই দিন তাঁকে সুনামগঞ্জে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাঁকে সুনামগঞ্জ জেলা আদালতে সোর্পদ করা হয়। আদালতে মজিবর রহমান জবানবন্দী দেন। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও পুলিশ ও গোয়েন্দারা মজিবর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মজিবর রহমান রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে অপহৃত হতে পারেন বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। মজিবর রহমানের হদিসহীন হওয়ার নেপথ্যে ॥ গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মজিবর রহমান সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। ১৫ বছর ধরে লন্ডনের ব্রিকলেনে সপরিবারে বসবাস করছিলেন। আখের গোছাতে তিনি যুক্তরাজ্যে যুবদল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সুবাদে তিনি যুক্তরাজ্য যুবদলের সভাপতি। যুক্তরাজ্য যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হওয়ার সুবাদে সেখানে অবস্থানরত বিএনপির একজন বিশেষ ব্যক্তির সহায়তাও পেয়ে যান। যুক্তরাজ্যে মজিবর রহমান চালকসহ নিখোঁজ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী মুক্তি পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন। সংগঠনটির ব্যানারে মজিবর রহমান যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির হালের একজন বিতর্কিত শীর্ষ নেতাসহ অন্যান্য বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, মজিবর রহমান আগাগোড়াই মারাত্মক প্রকৃতির মানুষ। ২০০৩ সালে লন্ডনের ব্রান্ডি সেন্টারে যুবদলের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় মতবিরোধের জের ধরে শত শত নেতাকর্মীর সামনে এক কর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। এ ঘটনায় তাঁর ৬ মাসের কারাদ- হয়। ২০০৪ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি লন্ডনের কেন্টের একটি কারাগার থেকে মুক্তি পান। নিয়মানুযায়ী লন্ডন পুলিশ মজিবর রহমানের শরীরে বিশেষ যন্ত্র লাগিয়ে দেয়। ওই যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তি কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন কিনা, তা মনিটরিং করা হয়। লন্ডনে মজিবর রহমান অনেক দিন ওই বিশেষ যন্ত্র নিয়েই ঘুরাফেরা করেন। গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০৯ সালে মজিবর রহমান লন্ডনে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি লন্ডনে বসবাসরত অনেক বাঙালী ও লন্ডনের গোয়েন্দাদের নজরে আসে। মাদক মাফিয়া হিসেবে লন্ডনে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। এমনকি বড়মাপের মাদক ডিলার হিসেবেও তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাদকের বড় বড় চালান পাঠানোই তাঁর প্রধান কাজ। লন্ডনে পাকিস্তানী মাদক মাফিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হয়ে মাদক পাচার করছিলেন। মাদকের টাকা আত্মসাৎ করার সূত্র ধরে মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়। মাফিয়াদের বহু টাকা তিনি আত্মসাৎ করে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। সে সব টাকায় সুনামগঞ্জ ও সিলেটে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেন। সেই বিরোধের জের ধরেই মজিবর রহমান আত্মগোপন করতে লন্ডন ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন। মাফিয়ারা মজিবর রহমানকে খুঁজতে সুনামগঞ্জেও এসেছিল বলে প্রচার আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১০ মাস আগে মজিবর রহমান যুক্তরাজ্যের ব্রিকলেনে বসবাসরত খুলকো মিয়া নামে এক বাংলাদেশীর কাছ থেকে এক লাখ পাউন্ডে ‘দি সেভেন স্টার বার’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিনে নেন। পরবর্তীতে নানা টালবাহানা করে বার কেনার টাকা দেননি। বিষয়টি লন্ডনের আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত বার কেনার সমুদয় টাকা জরিমানাসহ পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে আদালত মজিবর রহমানের লন্ডন ত্যাগের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। মাদক মাফিয়াদের টাকা আত্মসাৎ আর খুলকো মিয়ার টাকা পরিশোধের ঝামেলা এড়াতে হদিসহীন হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মজিবর রহমান লন্ডন থেকে গোপনে বাংলাদেশে চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন সুনামগঞ্জে। সুনামগঞ্জে মজিবর রহমানের কোন শত্রুতার তথ্য মেলেনি। নানা চাপে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের অজুহাতে আত্মগোপনে ছিলেন। এমন ঘটনার পরেও চাপের মুখে সরকার মজিবর রহমানকে চালকসহ ছেড়ে দিয়েছে বলে সরকারবিরোধীদের দাবি। যদিও হদিস হওয়া দুইজন ও তাদের পরিবারের তরফ থেকে এমন কোন অভিযোগ করা হয়নি। বেলার নির্বাহী পরিচালক রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর সন্ধান পাওয়া ॥ রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে অপহরণ করা হয় বলে পরিবারের অভিযোগ। এমন ঘটনায় বর্তমান সরকার দেশে গুমের রাজত্ব কায়েম করেছে বলেও বিএনপি-জামায়াতের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। পরে আবু বক্কর সিদ্দিক বাড়ি ফেরেন। চোখ বেঁধে মিরপুর ১০ নম্বর আনসার ক্যাম্পের কাছে মাইক্রোবাসে করে তাঁকে রেখে যায় বলে বলা হয়। তাঁর পকেটে বাসার যাওয়ার জন্য অপহরণকারীরা ৩শ’ টাকাও দেয় বলে দাবি করেন আবু বক্কর সিদ্দিক। মিরপুর থেকে অপহৃত দুই ভাই উদ্ধার ॥ চলতি বছরের ১৩ নবেম্বর রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন গোলটেক এলাকার ৫৪ নম্বর বাড়ি থেকে হদিসহীন হন দুই ভাই মোঃ ওমর ফারুক (৩৮) ও মোঃ ফিরোজ সরদার (৩৫)। তাদের পিতা হাকিম আলী সরদার (৭০) জনকণ্ঠকে বলেন, অপহৃত দুই ছেলে রাজধানীর নীলক্ষেত মার্কেটে নবযাত্রা নামের একটি বইয়ের দোকানের মালিক। তিন দিন পর তাঁদের সন্ধান মেলে। অপহরণের সর্বোচ্চ রেকর্ড ॥ পুলিশের পরিসংখ্যান মোতাবেক ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৯ হাজার ২৬৬টি অপহরণ মামলা হয়। এ সব মামলার মধ্যে ৫৬১টি মুক্তিপণ সংক্রান্ত ও ৩৩৪টি অপহরণ মামলা হয়। বাকি ৮ হাজার ৩৭১টি অপহরণ মামলা হয় জমিসংক্রান্ত বিরোধ, পাওনা টাকা আদায়, পূর্বশত্রুতা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণে। চলতি বছরের নবেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৮৫৬টি অপহরণ মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ সংক্রান্ত ১৮৪টি, পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলা ১১টি এবং জমিসংক্রান্ত বিরোধ, পাওনা টাকা আদায়, পূর্বশত্রুতা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণে বাকি ৬৬৬টি মামলা দায়ের হয়। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯শ’ থেকে সাড়ে ৯শ’ অপহরণ মামলা দায়ের হয়। কিন্তু সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে যায় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ২০০২ সালে। ওই বছর সারাদেশে অপহরণ সংক্রান্ত ১ হাজার ৪০টি মামলা রেকর্ড হয়। ১৯৭১ সালের পর এক বছরে এত মানুষ অপহরণের আর কোন ঘটনা ঘটেনি। এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অপহরণ সংক্রান্ত মামলা দায়েরের রেকর্ড। এ্যান্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড ॥ চলতি বছর অপহরণ আর গুমের অভিযোগ তুলে দেশ-বিদেশসহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে মাঠ গরম করার চেষ্টা করে সরকারবিরোধীরা। এমন ঢালাও অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে এ্যান্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড গঠন করে। ঢাকাসহ সারাদেশে দায়েরকৃত অপহরণ সংক্রান্ত অধিকাংশ মামলাগুলো সেলটিতে জমা হতে থাকে। শুরু হয় তদন্ত। অপহরণ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ॥ সেলটির দায়িত্বে থাকা একজন উর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, অপহরণ মামলার শতকরা ৯৫ ভাগই মিথ্যা। রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, দলীয়, জমিজমা সংক্রান্ত, প্রেম ঘটিতসহ নানা কারণে অপহরণ মামলাগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা স্বার্থ হাসিলের জন্য দায়ের হয়ে থাকে। এ সব মামলার তদন্তের গভীরে গিয়ে অপহরণের তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। এমনকি তদন্তের গভীরে যাওয়া মাত্রই বাদী বিবাদী আপোস হয়ে যায়। মিরপুর থেকে দুই ভাই অপহরণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটির তদারকির দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকী জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি অনেক অপহরণ মামলার তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই ভাই অপহরণের ঘটনাটি পাওনা টাকা লেনদেনের সূত্র ধরে। পাওনাদাররা দুই ভাইকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে দুই ভাই পাওনা টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্তি পান। দুই ভাইকে কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ বা অপহরণকারী চক্র অপহরণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ব্যাপারে অপহৃত দুইজনের পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি জনকণ্ঠের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, এছাড়া নানা অপরাধ করে নিজেকে আড়াল করতেও অনেকেই পরিবারের মাধ্যমে থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। যেমনটি হয়েছে পেশাদার সন্ত্রাসী মালয়েশিয়া প্রবাসী মনির খলিফার (২৭) ক্ষেত্রে। মনির খলিফার ভাই হারুন খলিফা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তে দেখা গেছে মনির খলিফার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ডাকাতি, অপহরণসহ ৬টি মামলা আছে। গ্রেফতার এড়াতে মনির খলিফা তাঁর ভাইকে দিয়ে অপহরণ মামলা করে আত্মগোপনে থেকে পরবর্তীতে মালয়েশিয়া চলে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি আরও জানান, এছাড়াও দেশে ছোট ছোট অপহরণকারী চক্র আছে। এ সব চক্র টাকা আদায়ের লক্ষ্যে অপহরণ করে থাকে। চক্রের টার্গেট যুবক ও কিশোর। চক্রটি প্রথমেই একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর যুবক বা কিশোর বয়সী পূত্রকে টার্গেট করে। তার মোবাইল নম্বর যোগাড় করে তার সঙ্গে অপহরণ চক্রে থাকা নারীদের দিয়ে প্রেমের ফাঁদ পাতে। সেই ফাঁদে পা দিলে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে অপহরণ করা হয়। মুক্তিপণ আদায় করে অপহৃতকে ছেড়ে দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালে প্রেমের ফাঁদে পড়ে অপহৃত হওয়া এক যুবককে উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতার করা হয় আয়েশা (২২) নামে এক যুবতীকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের ১০ থেকে ১২ জনের একটি অপহরণকারী দল আছে। আয়েশার প্রধান কাজই হচ্ছে ধনাঢ্য পরিবারের যুবক বা কিশোরদের প্রেমের ফাঁদে ফেলা। এক্ষেত্রে তারা ওই যুবকের পরিবারের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে। ধনাঢ্য অথচ সাধারণ পরিবারের সদস্যরাই তাদের টার্গেট। এমন অনেক ছোট ছোট অপহরণকারী চক্র থাকতে পারে। যারা টাকার জন্যই মূলত অপহরণ করে থাকে। তবে এ ধরনের অপহরণকারী চক্রগুলো সাধারণত অপহরণের পর অপহৃতকে হত্যা করার মতো রিস্ক নেয় না। অধিকাংশ মামলার তদন্তে দেখা গেছে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির জের ধরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই অপহরণ মামলা দায়ের এবং গুমের মতো মারাত্মক অভিযোগ করা হয়। অপহরণ ও গুমের বিষয়ে সরকারের বক্তব্য ॥ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, অপহরণ বা গুমের মতো অভিযোগ আগের চেয়ে বহুলাংশে কমে গেছে। বেশিরভাগ অভিযোগই ভিত্তিহীন বলে তদন্তে ধরা পড়ে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই অপহরণ বা গুমের অভিযোগ করা হয়। তবে সব অপহরণ বা গুমের অভিযোগ সত্য নয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, অপহরণ বা গুমের মতো ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। অপহরণ মামলা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে সব অপহরণ বা গুমের অভিযোগ সত্য নয়। এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে গঠিত এ্যান্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড অপহরণ মামলাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে। পুলিশ ও র‌্যাবের তরফ থেকে যেকোন ধরনের অপহরণ বা গুমের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়ে থাকে। অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে সফলতা অনেক।
×