ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তুর্কি প্রবাহের আগমন

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

তুর্কি প্রবাহের আগমন

সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির লাগাম স্থিতিশীল রাখার জন্য তুর্কিদের জ্বালানিশক্তির দরকার, প্রচুর জ্বালানি। প্রাক্তন ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের খ-াংশ সৌদি আরব বা ইরাক যেমন তেল ও গ্যাসের সমুদ্রে ভেসে রয়েছে তুর্কিদের মাটির নিচে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ফলে, জ্বালানি গ্যাসের বিরাট পরিমাণের সরবরাহ আসে রুশদের কাছ থেকে। আসলে রুশ গ্যাসের বৃহত্তম বাজার হলো ইউরোপ, তারপরেই তুর্কি বাজার। ইউরো-এশিয়ার ক্রসরোডে অবস্থিত বলে তুরস্ক আবার জ্বালানিশক্তির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল (হাব) হতে চাইছে। রুশ জ্বালানিশক্তি সরবরাহের ইতিহাসে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। সোভিয়েত আমল থেকেই তাবত ইউরোপ নির্ঞ্ঝাট গ্যাস-সরবরাহ পেয়ে আসছিল। ইউক্রেনে বিশাল মোটা মোটা চওড়া পাইপলাইন বসিয়ে সেই গ্যাস সরবরাহ হতো। সোভিয়েত প্রভাব-বলয় নির্মুক্তির পরে ইউক্রেন গ্যাস সরবরাহের ট্রানজিট দেশে পরিণত হয়। ট্রানজিট বাবদ বার্ষিক ফির ব্যবস্থাও হয়। কিন্তু ইউক্রেন গ্যাস ট্রানজিট নিয়ে ঝামেলা করতে থাকে, যেমন : নিজের কেনা গ্যাস বিল বকেয়া রাখা (কোটি কোটি টাকা), ত্যক্তবিরক্ত ক্রুদ্ধ গ্যাস সরবরাহ কোম্পানি গাজপ্রম ইউক্রেনগামী গ্যাসের মুখ বন্ধ করে দিলে ইউক্রেনীয়দের ইউরোপগামী গ্যাস চুরি করা। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির চরমমাত্রা ঘটে ২০০৯ সালে, কঠিন শীতের মৌসুমে। এবারে রুশ নির্ভরশীলতাকে ‘বাইপাসের’ পর্ব। জ্বালানিশক্তিতে পশ্চিমের রুশ-নির্ভরশীলতা মুক্তির প্রয়াস সঙ্গত, জ্বালানিশক্তি সরবরাহের কলকাঠির উপরে বিশ্বীয় ভূ-রাজনীতির কলকাঠিও প্রতিষ্ঠিত! ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস সাউথ স্ট্রিমের বিকল্প পাইপলাইন ‘নাবুকো’কে (নামকরণ হয় নেবুকাডনেজারের জেরুজালেম ধ্বংসকে ভিত্তি করে, রোমান্স ও হিংস্র্র বর্বরতা মেশানো জোসেফ ভার্দির অপেরা নাবুকো অনুসারে) হাজির করে। নাবুকো, তুরস্ক ও আজাবারইনকে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। ২০১৫ সালের মধ্যেই ঐ দেশগুলোতে কাস্পিয়ান সাগরের আজারি গ্যাসের প্রবাহও শুরু হবে। ফলে, ‘সাউথ স্ট্রিম’ গাজপ্রমের ড্রয়ারে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে নাবুকোকে বাতিল করে দিতেই হয়। কারণ দুটো। এক, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন বসাতে কোন ব্যাঙ্ক ধারকর্জ দিতে রাজি নয় (১০ বিলিয়ন ডলার), সর্বোপরি গ্যাস-সরবরাহকারী কোন দেশকে পাওয়া যায়নি। ফলে, নাবুকোর রোমান্স পর্বের ইতি ঘটে, নিষ্ঠুর বাস্তবতা চলে আসে। হাঙ্গেরি, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া আবার সেই পুরনো সাউথ স্ট্রিমের বায়না ধরে। সার্বিয়া বাদে বাকি দুই দেশই ইইউ ও ন্যাটোর সদস্য। এই পর্যায়ে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস দেশ তিনটিকে নরমে গরমে বশে রাখতে নিয়োজিত হয়। অবশ্য বিকল্প গ্যাস-সরবরাহ ব্যতিরেকে। সাউথ স্ট্রিম নির্মাণ চুক্তি সই হওয়ার পরবর্তীকালে ব্রাসেলস নতুন আইন পাস করে যে জ্বালানি ও পাইপলাইনের মালিকানা একই ‘এনটিটি’র দখলে থাকতে পারবে না, কিন্তু গাজপ্রম দুটোরই অধিকারী। (এই সময়টায় রুশবিরোধী নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ আরোপিত হচ্ছে এবং রুশরা গ্যাস পাইপের মুখ বন্ধ করেনি এবং করবেও না। তবে রুশদের যে বিশাল কৃষিজ পণ্যের বাজারটি ইইউ’র দখলে ছিল সেটির উপরে রুশরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে)। নতুন এই পরিপ্রেক্ষিতে তিন দেশ তিনভাবে আচরণ করে। স্বয়ং সিনেটর জন ম্যাককেইন সোফিয়াতে যান এবং বুলগেরিয়ার গ্যাস-বায়না সংযত করেন। অর্থাৎ, বলা যায় যে যদিও বুলগেরিয়ার বেজমারে ন্যাটোর একটি বিমান ঘাঁটি রয়েছে, কিন্তু তুর্কিদের মতো লিভারেজ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট সোচিতে গিয়ে পুতিনকে আশ্বস্ত করেন যে তারা সাউথ স্ট্রিম চায়। হাঙ্গেরিকে ব্রাসেলস কোনক্রমেই লাইনে আনতে পারছে না। দিন দুইতিন আগে বিরক্ত সিনেটর ম্যাককেইন কংগ্রেসে হাঙ্গেরীয় প্রেসিডেন্ট ওরবান সম্বন্ধে ‘নব্য ফ্যাসিস্ট’ ইত্যাদি কড়া কড়া কথাও বলেন। তাতে অবশ্য ঘৃতাহুতি হয়। কূটনৈতিক ঝামেলার মিটমাট হতে সময় লাগবে কিছুদিন। তবে ‘বিদ্রোহী’ ওরবানের ভাগ্য সত্তরের দশকের অস্ট্র্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী গাফ হুয়িটলামের মতো হবে কিনা কে জানে! দেখা যাক। তবে নিশ্চিত যে সাউথ স্ট্রিমকে ঘিরে যে টালবাহানা চলছে, বাস্তবায়িত আর হচ্ছে না। কারণ, সাউথ স্ট্রিমের নতুন বিকল্প হয়েছে। নতুন বিকল্পকে ‘তুকি স্ট্রিম’ বলা যায় অনায়াসে। ২০১০ সালে রুশ-তুর্কি উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই পরিষদের মিটিং করতে পুতিন যান আঙ্কারায়, সঙ্গে থাকে গাজপ্রমসহ আরও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের হোমরাচোমরারা। সেখানে সাউথ স্ট্রিমের বদলে তুর্কি স্ট্রিমের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়, গ্যাস ইউরোপে না গেলে যাবে তুরস্কে। গাজপ্রম ‘ব্লু স্ট্রিম’ নামক পাইপলাইনের মাধ্যমে তুর্কিদের গতবছর প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাঠিয়েছে। নতুন ব্যবস্থায়, কৃষ্ণ সাগরের তলদেশ দিয়ে নতুন পাইপলাইন তুরস্কে বছরে সর্বমোট তেষট্টি বিলিয়ন কিউবিক গ্যাস পাঠাবে। এবং নতুন পাইপলাইন তুর্কি-গ্রিক সীমান্তে গ্যাস বণ্টনের কেন্দ্রবিন্দু স্থাপন করবে। সাউথ স্ট্রিমের বিকল্প ব্যবস্থায় ব্রাসেলের লোকসানের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। তুরস্কের মতো অর্থনীতি ও রাজনীতিকে পৃথক রাখার দুঃসাহস না থাকায় এবং বিকল্পের অভাবে ইউরোপের জন্য রুশ-গ্যাস নির্ভরশীলতা থেকেই যাচ্ছে। চাপের মুখে বুলগেরিয়ার আচরণ যেমন ‘বানানা রিপাবলিক’তুল্য এবং ক্ষতিও জড়িত রয়েছে। যেমন, কেবলমাত্র ট্রানজিট ফি বাবদ বার্ষিক চার শ’ মিলিয়ন ডলার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং হাঙ্গেরি, সার্বিয়াসহ সব কয়টি দেশও ক্ষতির দলভুক্ত হচ্ছে। এই দেশগুলো ব্রাসেলসের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বসলে, সেটি হবে ইইউ’র আরেকটি অভ্যন্তরীণ ‘ফাইট।’ ন্যাটোর সদস্য ছাড়াও, এ পর্যন্ত রুশ জ্বালানিশক্তিকে বাইপাসের যে কয়টি মার্কিন উদ্যমপ্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে প্রতিটির সঙ্গেই তুরস্ক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, যেমন : নাবুকো, বা প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ‘বাকু-তিবলিসি-কীহান।’ শেষপর্যন্ত তুর্কি স্ট্রিমে এসে ‘নব্য ওসমানিয়া সুলতান’ এর্ডোয়ানের স্বপ্ন বাস্তব হতে যাচ্ছে, তুরস্ক গ্যাস-বণ্টনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। গাজপ্রমের সাবকন্ট্রাকটরির মাধ্যমে তুর্কিরা বুলগেরিয়াতে, সার্বিয়াতে, বলকান দেশগুলোতে রুশ-গ্যাস, রুশ তরল গ্যাসের সিলিন্ডার পাঠাতে সক্ষম হবে! নিরন্তর বাহ্যিক হস্তক্ষেপে অস্থিতিশীল অঞ্চলটিতে তুর্কি-রুশ মৈত্রী ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও রাখতে পারে। তাছাড়াও, আপাতত কাস্পিয়ান সাগরকে ঘিরে থাকা গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে বাইরের শক্তির বিশেষ ‘সখ্যতা’ স্থাপনও রুদ্ধ হচ্ছে। হধফরৎধযসধলঁসফধৎ@মসধরষ.পড়স
×