ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

বীমা কোম্পানি দাবি পরিশোধ করে না

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

বীমা কোম্পানি দাবি পরিশোধ করে না

সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে বীমা খাতের ওপর দুটো প্রতিবেদন পড়লাম দুটো ভিন্ন ভিন্ন কাগজে। আমরা সচরাচর খবর পড়ি ব্যাংকিং খাতের ওপর। সামান্যতম ব্যতিক্রম হলেই মিডিয়া ব্যাংকগুলোকে নিয়ে পড়ে। সেটা হতেই পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে আর্থিক খাতের অন্যতম বড় একটি খাতের খবর আড়ালে পড়ে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে? বলা বাহুল্য, এই খাতটি হচ্ছে বীমা খাত। বীমা খাতটি কত বড়, এর অধীনে কোম্পানির সংখ্যা কত, এর ব্যবসার অবস্থা কি, যারা বীমা করেন সাধারণ অথবা জীবন- তাঁরা তাঁদের ‘দাবি’ মোতাবেক টাকা-পয়সা পান কিনা এসব খবর অনেকেই রাখি না। আগে তো কোন খবরই পাওয়া যেত না। মন্দের ভাল এখন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়েছে, যার নাম ‘ইনসিওরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি’ (ইউরা)। এটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আগে বীমা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত ‘কন্ট্রোলার অব ইনসিওরেন্স।’ এখন তা নেই। আগে বীমা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয় ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় তা করে। সেখানে রয়েছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তারাই এখন বীমার নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়। এসবই ইদানীংকালের খবর। এত সত্ত্বেও বীমা খাতের খবর ভাল পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন পরপরই বীমা খাতের অনিয়মের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভাগ্যিস সেটা বীমা খাতের খবর, ব্যাংকের নয়। ব্যাংকের খবর হলে বড় করে ছাপা হতো। বীমা বলে কথা! ছোট করে খবর। কিন্তু খবরের মর্মার্থ যা তা রীতিমতো ভয়াবহ। ব্যাংকের আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখে। সেই টাকা ফেরত না পেলে কি অবস্থা হতো! বড় বড় খবর হতো। দেশে হৈচৈ পড়ে যেত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বীমা খাতের কোম্পানিগুলো যারা পলিসিহোল্ডারদের কাছ থেকে নানা প্রকল্পের অধীনে টাকা নেয় অর্থাৎ প্রিমিয়াম নেয়, সেই পলিসিহোল্ডারদের টাকা যখন পাওনা হয় তখন তা পরিশোধ করা হয় না। এটা আমার কথা নয়। গত ১০ তারিখের একটি দৈনিকে বিশাল শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। এতে বলা হয়, বীমা কোম্পানিগুলো ‘পলিসিহোল্ডারদের’ ‘ক্লেইম’(দাবি) পরিশোধ করে না। ‘প্রিমিয়াম ইনকামের ওপর সরকারকে যে ভ্যাট প্রদান করতে হয় তারা তা ফাঁকি দেয়। কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের সঙ্গে যে ‘অঙ্গীকার’ (কমিটমেন্ট) করে তা তারা হরহামেশাই ভঙ্গ করে। খবরটিতে বলা হয়েছে, এইসব অভিযোগ সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি পরীক্ষা করে দেখবে। বলা বাহুল্য, এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি। কমিটির মাননীয় সদস্যগণের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের কাছে বহু অভিযোগ রয়েছে ‘দাবি পরিশোধ না করার’ অর্থাৎ ক্লেইম সেটেলমেন্ট না করার। কমিটি দেশের ৭৭টি জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানির অনিয়ম পরীক্ষা করে দেখবে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি এক লাখ টাকার একটা ‘দাবি’ আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নিষ্পত্তি হয়েছে। বলা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ এতে ভোগান্তির শিকার। কখনও কখনও ‘দাবি’ পরিশোধ করা হয় না। কখনও অল্প টাকা দিয়ে ‘দাবি’ পরিশোধের চেষ্টা করা হয়। পলিসিহোল্ডার ও বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লেগে আছে বাদানুবাদ। এদিকে ২০ তারিখের আরেকটি খবরে দেখা যাচ্ছে ‘ইউরা’ সকল জীবন বীমা কোম্পানিকে চলতি বছরের হিসাব ৩০ জানুয়ারির মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে। এর জন্য ১৭টি ছক নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বীমাগ্রহীতাদের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ছকের মধ্যে আছে প্রথম বর্ষ ব্যবসা, কমিশন প্রদান, উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন, প্রশাসনিক ও অন্যান্য খরচ, নবায়ন কমিশন, মোট ব্যবস্থাপনা খরচ, বিনিয়োগ, জীবন বীমা তহবিল, ব্যাংক জমা, ব্যাংক ব্যালেন্স, ক্যাশ ব্যালেন্স, এজেন্ট ব্যালেন্স নবায়ন, বকেয়া প্রিমিয়াম ব্যালেন্স, কালেকশন ইনহ্যান্ড, আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম এবং অন্যান্য ব্যাখ্যা। এসব তথ্য চাওয়ার তালিকা থেকে বোঝা যাচ্ছে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো যে ‘ব্যালেন্স শীট’ তৈরি করে তা থেকে এইসব খবর পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব স্বচ্ছতা আনয়নের খাতিরে এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। পরিষ্কার বোঝা যায় বীমা কোম্পানিগুলোর হিসাবে গ-গোল আছে। ওপরের দুটো খবর থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কী সাধারণ বীমা কোম্পানি, কী জীবন বীমা কোম্পানি এর কোনটার স্বাস্থ্যই ভাল নয়। তথ্যে দেখা যায় তাদের ব্যবসা ভাল। মতিঝিলের আশপাশে অনেক বীমা কোম্পানি জমি কিনে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছে, যা অনেক ব্যাংকও এখন পর্যন্ত পারেনি বলে বাজারে খবর। বীমা কোম্পানিগুলোর এই রমরমা ব্যবসার পাশাপাশি যখন দাবি পরিশোধ (ক্লেইম সেটেলমেন্ট) সংক্রান্ত তথ্যগুলো বিবেচনায় আনা হয়, তখন দেখা যায় তারা মুনাফা করছে ঠিকই কিন্তু বীমা গ্রহীতাদের ঠকাচ্ছে। বিভিন্নভাবে বললে বলতে হয়, সাধারণ বীমা গ্রহীতারা অনেক বীমা কোম্পানির প্রতারণার শিকার। আমি একটি ঘটনা জানি। ঘটনাটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের। সীমান্ত অঞ্চলের একটি দরিদ্র পরিবারের প্রধান গ্রামের দালাল দ্বারা প্ররোচিত হয়ে একটি বীমা কোম্পানিতে জীবন বীমা করে। ভদ্রলোকের আয়ের উৎস খুবই সীমিত। ছোট্ট মাছের জাত ব্যবসা। তার ওপর তার ঢাকাস্থ মেয়ের সামান্য মাসিক কিছু আয়। মেয়েটি বাসাবাড়ির ‘ডমেস্টিক হেল্প’। দালালের খপ্পরে পড়ে সে বীমা গ্রহণ করে। তিনটি কিস্তির টাকা দেয়। দুটোর রসিদ বীমা গ্রহীতার কাছে আছে। তৃতীয়টির রসিদ দালাল আর বীমা গ্রহীতাকে দেব দিচ্ছি বলে দেয়নি। ইতোমধ্যে ভদ্রলোক স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। আর শুরু হয়ে যায় হয়রানি। দালাল ও বীমা কোম্পানির কাছে ‘ক্লেইম সেটেলমেন্টের’ জন্য দৌড়াদৌড়ি। কয়েক মাস ঘুরে গাঁটের টাকা শেষ করে এই দৌড়াদৌড়ির পরিসমাপ্তি ঘটে। এই পর্যায়ে বিষয়টি আমার নজরে আসে। আমি ঢাকায় বীমার সঙ্গে জড়িত এক ছাত্রবন্ধুকে বিষয়টার কথা বলি। তাকে কাজগপত্র দিই। বীমার টাকা পরিশোধের জন্য ‘নমিনির’ দরখাস্ত, ডাক্তারের সার্টিফিকেট, প্রিমিয়াম পরিশোধের কাগজপত্র ইত্যাদি জমা দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিসে। দুইমাস পর ফেরতা চিঠি আসে বীমা কোম্পানি থেকে। তারা যে কাগজপত্রগুলো চায় সেগুলো হচ্ছে : মূল বীমা দলিল, মৃত্যুর সনদপত্র, সর্বশেষ/প্রথম প্রিমিয়াম রসিদ, মরহুমের বয়স প্রমাণপত্র। বলা বাহুল্য, এগুলো বীমা গ্রহীতার আছে এবং তা দেয়া হয়েছে। এরপরেও যে তথ্যগুলো এবং প্রমাণপত্র চাওয়া হয়েছে তাই হচ্ছে চিন্তার বিষয়। চিতাশালার সনদপত্র (যিনি শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন তার সনদপত্র), সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন, মৃত ব্যক্তির জীবিত অবস্থায় চিকিৎসা সংক্রান্ত সমুদয় কাগজপত্র, ইউপি চেয়ারম্যানের মৃত্যু সনদপত্র ইত্যাদি। এবার ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করা যায়। মাত্র ৪০ হাজার টাকার ‘দাবি’। গ্রামের শ্মশান কোথায়? নদীর পারেই শেষকৃত্য। কে সনদ দেবে এই ক্ষেত্রে? পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন কেন? এটা তো অস্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন কেন? গরিব মানুষের চিকিৎসা আবার কী? কবিরাজি ওষুধ খেয়েছে। গ্রাম্য ডাক্তারের ‘তুকতাক’ খেয়েছে। এখন প্রশ্ন- ডাক্তারের সনদ দেয়ার পর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের সনদ কেন? কে যোগাড় করবে এসব? অশিক্ষিত বীমাগ্রহীতার গ্রাম্য অশিক্ষিত নিরীহ বিধবা স্ত্রী এসব যোগাড় করে কোম্পানিতে যাবে? থানার সনদ কে যোগাড় করবে? এসব গ্রামের একটি নিরীহ পরিবারের লোকের পক্ষে সম্ভব? এক কথায় বলা চলে, বীমার টাকা দেবে না বলেই এত কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা। গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষকে এক শ্রেণীর এনজিও ঠকাচ্ছে। মাল্টিলেভেল কোম্পানিগুলো নিরীহ মানুষকে ঠকাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বহু কষ্ট করে সামান্য কিছু সঞ্চয় করে। সেই সঞ্চয়ের টাকা গ্রাম্য টাউটরা লুট করে। লোভ দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে বিভিন্ন জাতের এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থা মানুষের সর্বস্ব হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা গরিব মানুষের পৈত্রিক ভিটাতেও হাত দিচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে বীমা কোম্পানিগুলোও একই পথ ধরেছে। তারা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে। নানা রকমের ‘প্রোডাক্ট’ দেখিয়ে মানুষকে প্রলোভিত করছে। এক শ্রেণীর দালাল এতে সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ‘ইউরা’ যদি সতি সত্যি ‘কামড়’ না দেয় তাহলে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রামকে ছারখার করে ছাড়বে, গরিব মানুষের যা কিছু সঞ্চয় আছে তাও লুট করবে। দেশে এমনিতে সঞ্চয় স্থবির। এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×