ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন দিন সময় পেলেই পাচার হয়ে যেত

পল্টন থেকে উদ্ধারকৃত সোনার গন্তব্য ছিল ভারত

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

পল্টন থেকে উদ্ধারকৃত সোনার গন্তব্য ছিল ভারত

আজাদ সুলায়মান ॥ পল্টন থেকে উদ্ধারকৃত ৬১ কেজি সোনার গন্তব্য ছিল ভারত। আর তিন দিন সময় পেলেই সেটা পাচার হয়ে যেত। কিভাবে সড়ক পথে সোনার বস্তা সীমান্তে পাঠানো হতো সেটাও ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু তার আগেই বাগড়া দেয় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। মোহাম্মদ আলীর পরিকল্পনা ভ-ুল করে দিয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই সব তছনছ করে দেয়। আর মোহাম্মদ আলী এখন বিমানবন্দরের শুল্ক গোয়েন্দার অফিসে বসে আফসোস করছেন। অবশ্য তিনি এখনও স্বীকার করছেন না এ সোনা তাঁর। জনকণ্ঠের কাছে বেশ জোরগলায় বলে ওঠেন, ‘উদ্ধার করা সব টাকাই আমার, সোনা আমার না, এটা সিরাজগঞ্জের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনের। তাকে জিজ্ঞেস করুন। সে আমার কাছে রাখতে দিয়েছে, তাই রেখেছি।’ তবে রিয়াজ উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাব দিয়েছেন আরও তীর্যক কণ্ঠে, ‘সবই ষড়যন্ত্র; সবই ষড়যন্ত্র। আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্যই এমন করা হচ্ছে। আমি মোহাম্মদ আলী নামের কাউকে চিনিই না।’ রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিমানবন্দরে টাকার জব্দ তালিকা ও গণনা শেষ হয়নি। যে কারণে মামলাও দায়ের করা সম্ভব হয়নি। রাত দশটা নাগাদ সেটা শেষ হওয়ার আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ টাকা মেশিনে গোনা যেত। কিন্তু পরে মামলা চলার সময় আসামিরা নানা অজুহাত দেখানোর সুযোগ পেত। সেজন্যই হাতে গুনে প্রতিটি নোটের নাম্বার লিখে সিজার লিস্ট তৈরি করা হচ্ছে, যাতে বিচারের সময় সব ঠিকঠাক থাকে। টাকা যাতে খেলনা নোট না হয়ে যায় সে জন্যই এত কঠিন কাজ করতে কাজ হচ্ছে। এদিকে মোহাম্মদ আলী ও রিয়াজ উদ্দিনের পরস্পরবিরোধী অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান বলেন, ‘আসামি কি কোনদিন স্বীকার করে? মোহাম্মদ আলীর সব বক্তব্য সত্য নাও হতে পারে। তবে আমরা মনে করি এখানে রিয়াজ উদ্দিনকেও তদন্তকারীরা জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে। তবে মামলার এজাহারে আপাতত রিয়াজ উদ্দিনকে আসামি করা হবে না। শুধু মোহাম্মদ আলীর স্বীকারোক্তি হিসেবে বর্ণনায় থাকবে। পরে তদন্তে বেরিয়ে এলে আসামি করা হবে। শুক্রবার সন্ধ্যায়ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায় এলাহী কা-। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের ১০-১২ জন সদস্য টাকার জব্দ তালিকা করতে করতে ক্লান্ত। উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এ সময় জানান, বৃহস্পতিবার রাত দুটো থেকে পালাক্রমে এ কাজ শুরু করা হয়। কখন শেষ হবে বলা মুস্কিল। এ সময় দেখা যায়, এক হাজার ও পাঁচ শ’ টাকার নোটের বান্ডিল বের করা হচ্ছে পাশে রাখা বস্তা থেকে। একটা দুটো নয়, পাঁচ বস্তা ভর্তি টাকা গুনে গুনে নাম্বার লিখে প্রতিটি নোটের বিপরীতে আলাদ সূচী তৈরি করতে হয়। এ সব টাকা নতুন ও পুরনো দুই ধরনেরই। তাই নাম্বার ধারাবাহিকভাবে মিলে না। এতে সময় লাগছে। কষ্টও বাড়ছে। সব টাকার নাম্বার লিপিবদ্ধ হওয়ার পর মোট পরিমাণ নির্ণয় করা হবে। কত টাকা ছিল ঘরে- জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী চটজলদি জবাব দেন, ‘ধরে নিন সাড়ে চার কোটি তো হবেই। হয়ত কয়েকটা নোট কম-বেশি হতে পারে।’ জানা যায়, রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোন মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। টাকা গণনা ও জব্দ তালিকা না শেষ হওয়া পর্যন্ত মামলা দায়ের করা যাবে না। এ জন্য আটককৃত মোহাম্মদ আলীকেও কাস্টমস হলেই বসিয়ে রাখা হয়। এ বিষয়ে উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মামলার এজাহার লেখা প্রায় শেষ। শুধু সিজার লিস্ট তৈরি হলেই থানায় পাঠানো হবে। এদিকে স্মরণকালের বৃহৎ এ টাকার চালান আটক হওয়ায় বিমানবন্দরে কর্মরতদের মাঝেও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। নিরাপত্তাকর্মী আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বিশ বছর ধরে এয়ারপোর্টে চাকরি করছি। বস্তার পর বস্তা ভর্তি এত টাকা জীবনে কখনও দেখিনি। ব্যাটার কত বড় সাহস এতগুলো টাকা সে ঘরে রেখেছে। কাস্টমসের সদস্যরাও এতে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে টাকা গোনা হচ্ছে। শুক্রবার রাত নয়টায়ও শেষ হচ্ছে না। এত টাকা একত্রে দেখে আগত যাত্রীরাও কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। কিন্তু এত টাকা ঘরে রাখার কারণ কী- জানতে চাইলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উদ্ধারকৃত ৬১ কেজি সোনা দুবাই থেকে আনা হয়। সেটা বিমানবন্দর দিয়েই আনা হয়। গন্তব্য ছিল ভারত। পল্টনের মোহাম্মদ আলীর বাসা থেকে যখন সোনা জব্দ করা হয় তখনও ওই ফ্ল্যাটে আরও দুজন বহিরাগত ছিল। গোয়েন্দাদের হানা টের পেয়ে তারা দুজন কেটে পড়ে। মোহাম্মদ আলী ওই সোনার মালিক হিসেবে সিরাজগঞ্জের রিয়াজ উদ্দিনের নাম বললেও মূলত তাঁর বাসা থেকেই এ চালান ভারতে পাচারের প্রস্তুতি চলছিল। আর তিনটে দিন পরই বস্তায় ভরে সড়ক পথে বেনাপোল দিয়ে পাচার করা হতো ভারতে। সূত্রমতে, মোহাম্মদ আলী নিজেই একজন বড় গডফাদার। তাঁর বাসায় এত টাকা থাকার কারণÑ এ জাতীয় চোরাচালানে যে কোন সময় পাঁচ-দশ কোটি টাকা লাগতে পারে। এ সোনার অর্ধেক ছিল বেশ আগের আনা। বাকি অর্ধেক আনা হয় সপ্তাহখানেক আগে। শুল্ক গোয়েন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘মোহাম্মদ আলী এতটাই প্রভাবশালী গডফাদার, তিনি ধরা পড়ার পরও ডেমকেয়ার। এতটুকু বিচলিত নন। ভাবখানা এমন- যেন এটা কিছুই নয়। বাসায় টাকা থাকতে পারেই; সোনা আরেকজনের। তাই তাঁর কোন বিপদ হবে না। ঠিকই সে দুদিন পর জামিনে বেরিয়ে এসে ফের শুরু করবেন এ ব্যবসা।’ কী তাঁর পরিচয়- জানতে চাইলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোহাম্মদ আলী পল্টন এলাকায় পরিচিত একজন মিষ্টি ব্যবসায়ী। তাঁর বাসা পুরানা পল্টনের ২৯/১ নম্বরে। বাড়ির নাম ‘ঠিকানা’। তাঁর ছয়তলায় একটি ফ্ল্যাট। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরে। তিনি ‘সাফা হোমস’ নামে একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। পল্টনে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়। পাশাপাশি ধানমন্ডিতে ‘আলী সুইটস’ নামে তাঁর একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। পল্টনের ওই বাসায় থাকেন মোহাম্মদ আলী, তাঁর স্ত্রী রোজিনা বেগম, দুই ছেলে, এক মেয়ে, এক ভাতিজা এবং তিনজন গৃহকর্মী। ছেলেমেয়েরা জানান, তাদের মা কিছুদিন ধরে অসুস্থ। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ বাসায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ৬১ কেজি ওজনের ৫২৮টি স্বর্ণের বার ও পাঁচ বস্তা টাকা ও ১৪ লাখ টাকা মূল্যের সৌদি রিয়াল। উদ্ধারকৃত স্বর্ণের দাম প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এ সময় তাঁকেও আটক করা হয়। তখন নিজেকে আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়া মোহাম্মদ আলী জানান, সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন স্বর্ণের বারগুলো তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন। উদ্ধার করা টাকা ও সৌদি রিয়াল তাঁর নিজের। যদিও এত টাকা-মুদ্রা ও স্বর্ণের বার কোথা থেকে এলো তার জবাব দিতে পারেননি। এ সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই বাসায় অবৈধ স্বর্ণ ও মুদ্রা থাকার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। এরপর ডিবির সহযোগিতা নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ সেখানে অভিযান চালায়।
×