ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোটরপার্টসের ভেতরে ঢুকিয়ে সারাদেশে সরবরাহ ॥ চীন থেকেও আমদানি

ধরা পড়েছে মোস্টওয়ান্টেড ইয়াবা গডফাদার আলো, চাঞ্চল্যকর তথ্য

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ধরা পড়েছে মোস্টওয়ান্টেড ইয়াবা গডফাদার আলো, চাঞ্চল্যকর তথ্য

স্টাফ রিপোর্টার ॥ টায়ার, টিউব, মোটর পার্টস থাকে গ্যারেজে। ব্যবহার হয় গাড়িতে। তাতে আবার ইয়াবা থাকে কি করে? এমন কৌতূহলী প্রশ্ন ছিল খোদ র‌্যাবেরও। তারপরও সোর্স যেহেতু নিশ্চয়তা দিচ্ছে, তাই অভিযান চালানোর উদ্যোগ। ভাল করে নেয়া হয় খোঁজখবর। সোর্সের পর সোর্স কাজ করে। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার রাতে যখন অভিযান চালানো হয়, তাতেই ধরা পড়ে যায় মোস্টওয়ান্টেড ইয়াবা গডফাদার জাহিদুল ইসলাম আলো। তারপর র‌্যাব যা দেখল, আর উদ্বার করল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর, অবিশ্বাস্য। কিছুতেই হিসাব মিলছিল না কি করে, মোটর পার্টসের ভেতরে বছরের পর বছর ধরে কক্সবাজার ও চট্রগ্রাম থেকে ইয়াবা আনা হচ্ছে। কক্সবাজার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত কি কায়দায় আনা হয়েছে, কারা কারা জড়িত, কে কতো টাকা কামায় সব জেনে যায় মুুহূর্তেই। ধরা পড়ার পর শুক্রবারই তাদের নিয়ে আসা হয় র‌্যাব সদর দফতরে। এখানেই জরুরী সাংবাদিক বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে জানানো হয় অজানা সব তথ্য। এই প্রথমবার র‌্যাব জানতে পারে, এখন শুধু মিয়ানমার নয়, চীন থেকেও আসছে ইয়াবার চালান। র‌্যাব মনে করছে, এটা জাতির জন্য খুবই উদ্বেগের। চীন থেকে যদি ইয়াবার চালান আসে, তাহলে সেটা সামাল দেয়াও হবে খুবই কঠিন। ইয়াবা সম্রাট জাহিদুল ইসলাম আলো ছাড়াও আরও যারা ধরা পড়েছেন তারা হলেন- জসিম উদ্দিন রানা, আব্দুল মালেক রাসেল, শাহেদ, জাবেদ ও জাকির। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুই লাখ ২১ হাজার ৫৩১টি ইয়াবা, ইয়াবা বিক্রির ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫ টাকা, একটি বিদেশী পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিন, বেশকিছু পিস্তলের গুলি, একটি মোটর বাইক, একটি টয়োটা গাড়ি, ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করার জন্য মোটর গাড়ির ৩৭টি ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, তিনটি মোবাইল ফোন, আটটি ল্যাপটপ, ব্যাংকের তিনটি চেক বই এবং ক্রেডিট কার্ড। গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে র‌্যাব জানতে পারে, চট্টগ্রামে জাহিদুল ইসলাম আলো নামে এক ব্যক্তি মিয়ানমার ও চীন থেকে ইয়াবা আমদানি করে অভিনব পন্থায় মোটর পার্টসের বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করে আসছে। ওই চক্রকে ধরার জন্য র‌্যাব সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়। বিভাগীয় সোর্স ছাড়াও তিনজন ইয়াবাসেবী সোর্সের মাধ্যমে র‌্যাব কক্সবাজার থেকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত ফাদ পাতে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দফতরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে র‌্যাব-৭ এর একটি চৌকস টিম অভিযান চালায় হালিশহরে। এখানে প্রথমে আটক করা হয় জাহিদুল ইসলাম আলোকে। সে সময় আলো অবস্থান করছিল হালিশহরের ১৪৮২ নং বাড়িতে। তার সঙ্গে আটক করা হয় তার চালক জসিম উদ্দিন রানাকে (৩৫)। উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৩ রাউন্ড গুলি, ২০,০০০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ১টি প্রিমিও প্রাইভেটকার। (রেজিঃ নং-ঢাকা মেট্রো গ-৩১-৮৩১০)। তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে জাহিদুল ইসলাম আলো এই চক্রের মূল হোতা। চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর থানাধীন রামপুর আমিন কন্ট্রাক্টর রোডস্থ বাড়িতে (নং-১৪৮২) বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট মজুদ করা আছে। বিভিন্ন ব্যাংকে তার মাদক বিক্রির ২,৫৮,৫০,৭৯৭ টাকা জমা করা আছে। র‌্যাবের অভিযান দলটি পরে বিভিন্ন ভাড়া বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ১,৯০,৩১৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ইয়াবা বিক্রির নগদ ১৮,৯৯,০৬০ টাকা, ১টি হিরো হোন্ডা সিবিজেড মোটরসাইকেল, ৩৭টি বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল সেট, ১টি ভিডিও ক্যামেরা, ২টি ক্যামেরা, ২০টি বিভিন্ন কোম্পানির সীম কার্ড, ৩টি ল্যাপটপ, ইয়াবা পরিবহনের অভিনব যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে। এ সময় বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি চেকবইসহ আব্দুল মালেক রাসেল (২৭), মোঃ শাহেদ (২৪), মোঃ জাবেদ (২৫), মোঃ জাকিরকে (২৬) আটক করা হয়। তাদের একত্রে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় র‌্যাব। সে তথ্য নিয়ে ঢাকায় ফিরে অভিযান চালানো হয়। শুক্রবার ভোরে র‌্যাব টঙ্গীর মোটর টেম্পোস্ট্যান্ড এলাকা থেকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। এ অভিযানে মোট ২,১৫,৩১৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং মাদক বিক্রির নগদ ১৮,৯৯,০৬০ টাকা উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব জানায়, জাহিদুল ইসলাম আলো দীর্ঘদিন যাবত ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বোন জামাই মোঃ সগিরের (৩৬) মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। ২০১২ সালে সগির ইয়াবা ব্যবসা বাবদ আলোর কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা ধার নেন। ধারের টাকা দিয়ে সগির ইয়াবা ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হন। আলো বিষয়টি জেনে অল্প সময়ে বিত্তবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সগিরের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে সগির ইয়াবা এবং অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হন। তার দেয়া তথ্যমতে জাহিদুল ইসলাম আলোকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। জেলহাজতে থাকাকালীন আলো এবং সগির জেলহাজতে থাকা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের যোগসাজশে ইয়াবা সিন্ডিকেটের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন। তারা দুজনই চার মাস হাজত বাসের পর জামিনে বের হন। তারপর নবউদ্যমে শুরু করেন ইয়াবার বাণিজ্য। মিয়ানমার ও চীন থেকে ট্রলারযোগে অভিনব পন্থায় মোটর পার্টসের বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালি, আনোয়ারা, ফিরিঙ্গী বাজার যা কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা দিয়ে চট্টগ্রামে তার নিজস্ব ও ভাড়াকৃত বাসায় নিয়ে আসতেন। সেখান থেকে সুবিধামতো সময়ে গ্রেফতারকৃতরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করতেন। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত অন্য সদস্যরা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তাদের আটকের জন্য র‌্যাব সক্রিয় রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, চট্টগ্রামের হালিশহর থানাধীন আনন্দপুর এলাকার তাসফিয়া কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে আলাউদ্দিন আলোকে আটক করে নিয়ে যায় র‌্যাব সেভেনের দফতরে। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর র‌্যাব সেভেন তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার করে। কিন্তু ঐ এলাকার লোকজনের তথ্য অনুযায়ী র‌্যাব সদস্যরা তার বাড়ি থেকে বৃহস্পতিবার বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ উদ্ধারের বিষয়টি স্বীকার করেনি। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র ১৯ লাখ টাকা নগদ উদ্ধারের বিষয়ে র‌্যাব স্বীকার করলেও এ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। র‌্যাব সেভেন সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আলাউদ্দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বিভিন্ন মাধ্যমে ইয়াবার চালান পাচার করেছে। নগরীর হালিশহর থানাধীন আনন্দপুর এলাকার তাসফিয়া কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন এলাকায় তার বসবাস। সপরিবারে তারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বুধবার আলাউদ্দিন আলোকে আটক করা হলে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে ইয়াবার চালান সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের বিষয়ে ব্যাপক তথ্য দিয়েছে। ফলে তার সঙ্গে থাকা সহযোগীদের গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। শুধু চট্টগ্রামেই নয় ঢাকায়ও অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত তার বাসায় অভিযান পরিচালনা অব্যাহত ছিল। শুক্রবার সকালেও ঐ এলাকায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব সদস্যরা। র‌্যাবের অভিযানে আলাউদ্দিন আলো আটকের পর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা সংরক্ষণ ও পাচারের কৌশল সম্পর্কে র‌্যাবকে জানিয়েছে। সে অনুযায়ী র‌্যাব সদস্যরা নগরীর হালিশহর, খুলশীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে। এ অভিযানে আলাউদ্দিন আলোর ভাই, স্ত্রী ও গাড়ির চালকসহ মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৫১৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, নগদ ১৯ লাখ টাকা, ৩৭টি মোবাইল সেট ও কয়েকটি ব্যাংকের চেক বই। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আলাউদ্দিন আলো স্বীকার করেছে সে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ইয়াবা ব্যবসার ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জমা রয়েছে। সে গাড়ির পার্টসের ভেতর দিয়ে ইয়াবা পাচার করত রাজধানী ঢাকাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এছাড়াও মোবাইলের ভেতরেও ছিল ইয়াবার চালান। এদিকে, আনন্দপুর এলাকায় আলাউদ্দিন আলো একজন মোবাইল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এক সময় সে মোবাইল চোর সিন্ডিকেটের হোতা ছিলেন। পরবর্তীতে নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারে দুটি দোকানও পজেশনে ক্রয় করেছেন। এর মধ্যে একটি নেয়া হয়েছিল তার ভাইয়ের নামে। পরবর্তীতে নিজের দোকানটি বিক্রি করে মোবাইল ব্যবসা থেকে সরে যান। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আলাউদ্দিন আলো বিভিন্ন সময়ে চোরাই মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের অপরাধে এমনকি মোবাইল চোর সিন্ডিকেট গড়ে তোলায় পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিল। পরবর্তীতে মোবাইল ব্যবসা ছেড়ে মোবাইলের ভেতর দিয়েই ইয়াবার চালান ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো শুরু করে। শেষ পর্যন্ত গাড়ির পার্টসের ভেতর দিয়ে ইয়াবার চালান বিপুল পরিমাণে পাচার করতে শুরু করে। বাড়ি, গাড়ি সবই আয়ত্ব করেছে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে সে। এ ব্যাপারে র‌্যাব সেভেন পরিচালক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ শুক্রবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আলাউদ্দিন আলোকে আটকের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। ঢাকাস্থ সদর দফতরে এ বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং হয়েছে। সেখানে সে উদ্ধারকৃত অর্থ ও ইয়াবার বিষয়ে এমনকি পাচারের কৌশলও স্বীকার করেছে।
×