ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারী নির্যাতন সেল যৌতুক নিয়েই সংসার ভাঙ্গে বেশি

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

নারী নির্যাতন সেল যৌতুক নিয়েই সংসার ভাঙ্গে বেশি

শর্মী চক্রবর্তী ॥ নারী নির্যাতনের শিকার অনেক নারী বিভিন্ন আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এসব নারীর বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। এমনই একজন নাসিমা। গরিব ঘরের সন্তান। পড়ালেখায় খুব আগ্রহ ছিল। এজন্য ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করছেন, ুএখনও কষ্ট করে চলছেন। অন্য সবার মতো তাঁর স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে একজন ভাল জীবনসঙ্গী নিয়ে ভাল থাকবেন। কিন্তু বিধি বাম। সুখ এসে ধরা দিল না নাসিমার কাছে। বাবা-মায়ের আদরবঞ্চিত নাসিমা এখন স্বামীর বাড়িতে গিয়ে শিকার হচ্ছেন নির্যাতনের। প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের। নির্যাতন সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে অভিযোগ করেছেন। বৃহস্পতিবার হাজিরা দিতে আসা নাসিমা বলেন, ছোটবেলা থেকেই জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করছি। ভেবেছিলাম স্বামীর সংসারে ভালভাবে দিন কাটবে, কিন্তু হলো না। আমার ওপর শুরু হলো অমানুষিক নির্যাতন। ২০১১ সালে বান্ধবীর বিয়েতে গিয়ে আবদুল্লাপুরে নাসিমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় শরিফুল ইসলামের। নাসিমা বলেন, কথা বলতে বলতে আমারও তার প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ জমে যায়। প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে কথা বলা। মাদ্রাসায় পড়ালেখার পাশাপাশি তার সঙ্গে কথা বলা একটা নিয়মিত কাজ ছিল আমার। ছোট থেকেই কারও ভালবাসা ও শাসন না পাওয়ায় শফিউলের সব কথা ভাল লাগত। সে যা বলত সেভাবেই আমি চলার চেষ্টা করতাম। একপর্যায়ে সে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমার মাদ্রাসায় আসে ২০১২ সালের শেষের দিকে। প্রথম দেখার পরই সে বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আমিওু রাজি হলাম। ’১৩ সালের ১৩ মার্চ আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর আমাকে নিয়ে যায় শফিউলের বাড়িতে। তাদের বাড়ির সবাই আমাকে মেনে নিলেও আমার বাড়ির অনেকেই এই বিয়ে মেনে নেয়নি। তখন বিভিন্নভাবে আমি আমার পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করি। একপর্যায়ে সবাই মেনেও নেয়। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হলো তার যৌতুক চাওয়ার কৌশল। অন্যদিকে আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন। কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তুলত আমার শাশুড়ি, ননদ ও স্বামী। তাদের বাড়িতে যাওয়ার পর শুনলাম আমার স্বামী কিছু করে না। বাড়ি থেকে টাকা নেয় আর সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। আর আমাকে পাওয়ার পর বেড়ে গেল তাদের কাজ। এমনকি বাসার বুয়াকে পর্যন্ত তাড়িয়ে দিল। এ অবস্থায়ই আমি ডিগ্রী পরীক্ষা দেই খুব কষ্ট করে। প্রতিদিন সকালে উঠে রান্না করে রেখে আমাকে কলেজে যেতে হতো পরীক্ষা দিতে। এতুসব কিছু করার পরও প্রতিদিন শফিউলের কাছে বিভিন্ন কথা বলে আমার শাশুড়ি নালিশ করত। আর এসব কথা শুনে নেশা করে এসেই আমাকে ধরে প্রচুর মারধর করত। এসব চলতে থাকে প্রায় ১ বছর ধরে। যখন আমি আর সহ্য করতে পারলাম না তখন আমি চলে আসি মাদ্রাসার হোস্টেলে। এসে আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দেই। শিক্ষকতার চাকরি নেই মাদ্রাসায়। আর নারী নির্যাতন সেলে অভিযোগ করি। প্রায় অনেকদিন হয়ে গেছে এখনো তারা কোন সমাধান দেয়নি। নাসিমা বলেন, আমার পক্ষে আর তার সংসার করা সম্ভব নয়। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই। আর যার সঙ্গে সংসার করব তাকে ভাল করতে গেলে যদি শাশুড়ি বাধা দেয়। নেশা করার টাকা দেয় সেখানে কিভাবে আমি ভাল থাকব। বৃহস্পতিবার শুনানি কর্মকর্তা মোমেনা আক্তারের সামনে এসব কথা বলেন নাসিমা। নাসিমা শিক্ষিত নারী। তিনি চাকরি করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান। অন্যদিকে শুনানি কর্মকর্তা বলেন, অনেকদিন যাবত তাদের এই অভিযোগটি আমার কাছে আছে। নাসিমা চায় না তার স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে। কিন্তু শফিউল চায় নাসিমাকে ফিরিয়ে নিতে। কারণ সে ফিরে না গেলে কাবিনের ২ লাখ টাকা তাকে দিয়ে দিতে হবে আর তা দেয়ার ক্ষমতা শফিউলের নেই। এ কারণে নাসিমা শঙ্কায় আছে, আবার তাকে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করবে তার স্বামী। নাসিমার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। পড়ালেখার জন্য ছোটবেলায় ঢাকার মিরপুরে এক খালার বাসায় এসে ওঠে। তখন থেকেই শুরু হয় কষ্টের দিন। মাদ্রাসায় ভর্তি হন। খুব কষ্টে খালার বাসায় থেকে কামিল পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। এরপর তেঁজগাও মদিলাতুলউলো মাদ্রাসায় ভর্তি হন তিনি। সেখানকাুর হোস্টেলেই থাকেন। নারী নির্যাতন সেলে প্রতিদিন এমন অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়। এখানে কারও সংসার ভাঙ্গে, কারও আবার জোড়া লাগে। বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তবে যৌতুকের কারণেই বেশিরভাগ সংসার ভাঙ্গে। শুনানি কর্মকর্তা এ্যাডভোকেট পারভিন আক্তার খান বলেন, প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন অভিযোগ সমাধান করি। তবে যৌতুকের কারণে সংসার বেশি ভাঙ্গে। এসব অভিযোগের শুনানি হয় ঠিকই কিন্তু ভাঙ্গে বেশিরভাগ সংসার। তিনি যৌতুক প্রথা বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
×