ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী আজ

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে দশম সাক্ষী আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের নবম সাক্ষী হাজী আবদুল আজিজ তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, সিরাজ মাস্টার বলে যে, আজকে সাতটা কল্লা পেয়েছি আরও তিনটা দরকার। ঐ তিনটা কল্লা আমারে দে। রাতে জানতে পারি রাজাকাররা মোট ৪২ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা করেন। পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আজ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত আসামি এ্যাডভোকেট শামুদ্দিনের জামিনের ওপর শুনানি ও অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার দায়ে জরিমানা ও এজলাসকক্ষে দাঁড়িয়ে থাকার রায় বিষয়ে ৫০ নাগরিকের বিবৃতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দৈনিক প্রথম আলোকে ওই বিবৃতির মূল কপি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে বলেছে ট্রাইব্যুনাল। একই রায়ের বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করায় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতি উষ্মা ও ওই সম্পাদকীয়তে বার্গম্যানের শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানানোয় বিস্ময় প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল। এটা পাবার পর পরবর্তীতে পরীক্ষার জন্য নিউইয়র্ক টাইমসের জন্যও প্রয়োজনীয় আদেশ দেয়া হবে। রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ আদেশ দিয়েছে। বাগেরহাটের তিন রাজাকার কসাই সিরাজ, আবদুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের নবম সাক্ষী জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন সাক্ষীকে জেরা করেন। অন্যদিকে সাক্ষীকে জবানবন্দী প্রদানে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আজ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’ সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, আমার নাম হাজী আবদুল। আমার বর্তমান বয়স ৮১/৮২ বছর। আমার ঠিকানা গ্রাম সাগরকাঠি, থানা-মোরেলগঞ্জ, জেলা-বাগেরহাট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ৩৯/৪০ বছর। ১৯৭১ সালের ১৮ কার্তিক রোজ শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৪টা সাড়ে ৪টার সময় আমি, হাশেম জমাদার ও কালু মুন্সী শাখারীকাঠি বাজারে আসি। বাজারে এসে আমরা দেখি যে, ৮০/৫০ জন রাজাকার। রাজাকাররা আমাদের গ্রামের ৪ জন হিন্দুসহ ৪০/৫০ জন হিন্দুকে জোড়া জোড়া করে বেঁধে হাটের পশ্চিম দিকে তাদের উত্তর-দক্ষিণ করে লাইন দেয়। ঐ রাজাকারদের হাতে রাইফেল, বন্দুক ও ছোরা ছিল। আমি কালু মুন্সি ও হাশেম জমাদার রাজাকার আফসার ও হারুন দিদারকে বলি যে, আটককৃত হিন্দুরা নিরীহ গরিব মানুষ। তাদের ছেড়ে দাও। তখন রাজাকার আফসার আমাদের বলে যে, তোমরা তিনজনও লাইনে গিয়ে দাঁড়াও। সে সময় রাজাকার আসামি সিরাজ মাস্টার বলে যে, আজকে সাতটা কল্লা পেয়েছি আরো তিনটা দরকার, ঐ তিনটা কল্লা আমারে দে। আসামি সিরাজ মাস্টার রাজাকার আফসারকে দেখিয়ে বলে যে ঐ তিনটাকে আমার দিকে ঠেলে দে। রাজাকারদের মধ্যে আসামি আবদুল লতিফ তালুকদার ও খান আকরাম হোসেনও ছিল। রাজাকার হারুন দিদার তখন আমাদের বলে তোমরা সরে যাও। তখন আমরা বাজারের দক্ষিণ দিক দিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে দক্ষিণ দিকে যাই। আমরা সেখানে অবস্থানকালে বাঁশির শব্দ শুনি এবং তার পরে গোলাগুলির শব্দ পাই। আমরা তিন জন গোলাগুলির শব্দ শুনে যে যার মতো করে পালিয়ে যাই। রাত ৮টা ৯টার দিকে জানতে পারি যে, রাজাকাররা মোট ৪২ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। পরের দিন সকাল আনুমানিক ৯টা-১০টার দিকে রাজাকাররা নৌকা করে ঐ লাশগুলো নিয়ে বৃষখালীর পূর্ব পাড়ে নিয়ে যায় এবং একটি গর্ত করে সব লাশ মাটিচাপা দেয়। ডেভিড বার্গম্যান ॥ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার দায়ে জরিমানা ও এজলাসকক্ষে দাঁড়িয়ে থাকার রায় বিষয়ে বিবৃতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দৈনিক প্রথম আলোকে ওই বিবৃতির মূল কপি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে বলেছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছে। একই রায়ের বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করায় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতি উষ্মা ও ওই সম্পাদকীয়তে বার্গম্যানের শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানানোয় বিস্ময় প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল। আদেশে দৈনিক প্রথম আলোকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত সংবাদের ৫০ বিশিষ্টজনের স্বাক্ষরিত বিবৃতির মূল কপি রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল। বিকেলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ট্রাইব্যুনালের এ আদেশ সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজুর রহমান খান। এ সময় ডেপুটি রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলে, গত ২০ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ ‘বার্গম্যানের সাজায় ৫০ নাগরিকের উদ্বেগ’ এবং গুুঁষরহম ঝঢ়ববপয রহ ইধহমষধফবংয শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। এ ধরনের সংবাদ এবং সম্পাদকীয় প্রকাশ আদালতের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে। গত ২৩ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ওই সম্পাদকীয় নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেছে, নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে অবমাননা করেছে। আদালত অবমাননার দায়ে ডেভিড বার্গম্যানের শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানিয়ে প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল আরো বলেন, আমরা বুঝতে পারছি না, কিভাবে একটি বিদেশী দৈনিক একটি স্বাধীন দেশের আদালতের আদেশ প্রত্যাহার করতে বলে! আদালত তার আদেশে আরও বলে, তার অর্থ হলো যে, যারা ঐ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তাঁরা মনে করছেন যে, অবমাননাকারী সাজা দেয়া হয়েছে ৭১ এর মৃত্যুর সংখ্যাকে সমালোচনা করার জন্যে। নিউইয়র্ক টাইমসে যে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে, সেখানে মত প্রকাশ করা হয়েছে সেটা হলো, সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় করার জন্য। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ন্যায় বিচার হবে তখন বার্গম্যানের সাজা দ্রুত তুলে নিতে হবে। আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলছে, আমরা বুছছি না কিভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পত্রিকা সার্বভৌম দেশের আদালতকে এভাবে বলতে পারে ট্রাইব্যুনালকে দ্রুত বার্গম্যানের সাজা তুলে নিতে। উপরোক্ত বিষয়ে ভুল বোঝার অবসান ঘটাতে ট্রাইব্যুনাল তার ক্ষমতা সীমানা প্রটেক্ট করার জন্য আমাদের জানা দরকার এই বিবৃতি জনগণের স্বার্থে করা হয়েছে কি না। কোন বিবেচনার ভিত্তিতে এই স্বাক্ষরকারীরা এমন বিবৃতি দিয়েছে, তা প্রথম আলোর সম্পাদককে ঐ ৫০ জনের বিবৃতির পূর্ণাঙ্গ কপি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। এটি পাবার পর একই ধরনের পরীক্ষার জন্যে নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে ব্যক্তিগত ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্য করে আদালত অবমাননার দায়ে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে ২ ডিসেম্বর পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সারাদিন কোর্টে বসে থাকার নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেন। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদ- ভোগ করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, যারা এই বিচারিক কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে চায় তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। আদালত আরো বলেছেন, তিনি বাঙালী জাতির আবেগকে আঘাত করেছেন। তাঁর লেখার উদ্দেশ্য ভাল ছিল না। তাঁর লেখার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাঁকে আমরা সতর্ক করছি যে, এ রকম ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত বিষয় নিয়ে যেন আর কোন সমালোচনা না হয়। রায়ের পর বার্গম্যান জরিমানার অর্থ ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন। ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই আবেদন করেন হাইকোর্টের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ। পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট সাঈদ মিজান। আদালতে শুনানিতে তিনি বলেন, ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি ‘আজাদ জাজমেন্ট এ্যানালাইসিস-১, ইন অ্যাবসেন্সিয়া ট্রায়াল এ্যান্ড ডিফেন্স ইনডিকোয়েন্সি’ এবং ‘আজাদ জাজমেন্ট এ্যানালাইসিস-২, ট্রাইব্যুনাল এ্যাজাম্পশন’ শীর্ষক লেখা প্রকাশ করেন। ডেভিড বার্গম্যানের ব্লগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় নিয়ে করা মন্তব্যেও আদালত অবমাননা হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ্যাডভোকেট মিজান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল বলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়, দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে লিখেছেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া এসব তথ্যের কোন ভিত্তি নেই।”
×