ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালীর বঙ্গবন্ধু ও শিল্পাচার্য

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

বাঙালীর  বঙ্গবন্ধু ও শিল্পাচার্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন দুই ভুবনের বাসিন্দা হলেও স্ব-স্ব ভুবনে তাঁরা নিজস্ব মহিমা ও শ্রমে কর্মে গড়ে তুলেছেন জাতির জীবনধারা। পশ্চাৎপদ বাঙালী জাতির জীবনকে তাঁরা সূর্যালোক হয়ে প্রজ্জ্বলিত করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসকের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, শাসন-শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেছেন, গড়ে তুলেছেন জনমত, সৃষ্টি করেছেন যুগান্তকারী বিপ্লব। বাঙালীর জীবন ধারায় আজীবন সম্পৃক্ত থেকেছেন। বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষায় অবিচল থেকে করেছেন লড়াই। বাঙালীর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন একই পথের পথিক। খাঁটি বাঙালীর জীবনাদর্শ। দু’জনেই খুব কাছাকাছি এসেছিলেন ইতিহাসের দায় মেটাতে। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই ভাবতেন। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই তাঁকে গভীরভাবে ভাবাত। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলেছিল। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বার বার দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দী থাকলেও কখনও কোন বিষয়ে আপোস করেননি। একজন আদর্শবাদী এবং আত্মত্যাগী রাজনীতিক হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাঙালী জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা, হয়েছেন জাতির পিতা এবং বিশ্বে বাঙালী জাতিকে বীর হিসেবে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র। কিন্তু পরাজিত শক্তির দেশী-বিদেশী সহচর বিপথগামীদের হাতে ঘটে নির্মম মৃত্যু। সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে। তিনি বিশ্ববরেণ্য একমাত্র বাঙালী নেতাÑ বলা হতো যাঁকে ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’ এবং ‘রাজনীতির কবি।’ শেখ মুজিবের জীবন জিজ্ঞাসার ধারায় যে বাঙালী কীর্তিমান পুরুষটি চোখের সামনে ভেসে উঠেন তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ব্রিটিশ ভারতের অধীন পূর্ববঙ্গে তিনিও জন্মেছেন। নিজেকে গড়েছেন সৃজনশিল্পের ধারায়। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। নানা বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তিনি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে গেছেন। নিজে যেমন ছবি এঁকেছেন তেমনি শিল্পী গড়ে তুলেছেন। পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের জীবনে তিনি শিল্পের ভুবন গড়ে দিয়েছেন। বাংলা, বাঙালী ছিল তার জীবন সাধনার পটভূমিতে। শেখ মুজিবের মতোই বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রাগ্রসরতার প্রসারে নিষ্ঠা, কর্ম, কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাঙালী জাতির সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা ও বাঙালীর জীবন অনুষঙ্গে তাকে প্রবহমান রাখায় তিনি নিবেদিত ছিলেন। শেখ মুজিব যেমন তাঁর দল গঠন করে তা বাঙালীর মুক্তি ও বিকাশের ধারায় প্রবাহিত করে রাষ্ট্র গঠন করেছেন, জয়নুল তেমনি ধারায় বাঙালীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে লালন করেছেন, তাকে অবয়ব দিয়েছেন। শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালেই যেমন বুঝেছিলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি মূলত বাঙালীকে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা থেকে পাঞ্জাবীদের উপনিবেশে পরিণতি হয়েছে, তখনই তিনি বাঙালী জাতিকে এই শোষণ নিপীড়ন থেকে উদ্ধারের পথে পরিক্রমণ শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখও করেছেন। ছাত্র জীবনে তাঁর মতো জয়নুলেরও কেটেছে কলকাতায়। যেখানে পূর্ববঙ্গের শিল্পীরা জীবিকার প্রয়োজনে এমন সব ছবি এঁকেছেন যা, না এদেশের, না ওদেশের। জয়নুল এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে উপলব্ধি করলেন পূর্ববঙ্গের নিজস্ব যে শিল্পধারা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন গতিতে সুদূর অতীতে থেকে প্রবহমান, সেই শিল্পের ধারা লোকশিল্প। যা একমাত্র সজীব শিল্পধারা। তিনি এই ধারাকে রক্ষা ও বিকাশে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। ১৯৪৮ সালে তিনিও উপলব্ধি করলেন, স্বদেশ বাস্তবতাকে এভাবে যে, পূর্ববঙ্গে শিল্পচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই প্রতিষ্ঠান গড়ায় গড়িমসি করতে থাকে। কিন্তু জয়নুল এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে তার অধ্যক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করান। জয়নুল কলকাতায় খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে বন্ধু-স্বজন ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। যেমন ফিরে এসেছিলেন কলকাতায় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা শেখ মুজিব। বিশ শতকে চিত্রশিল্পে নানা বিবর্তন ঘটলেও জয়নুল তাঁর অনুসৃত ধারা থেকে একটুও সরেন নি। বাংলার মেহনতি মানুষ, চাষী, মাঝিমাল্লা, গাড়োয়ান, সাঁওতাল রমণীকে উপজীব্য করেছেন চিত্রকর্মে। নিছক বাস্তবতা নয়, বিক্ষোভ, ধিক্কার, ঘৃণা, সেøাগানে যে শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে বাঙময়। এসবের মধ্যে কথামালা সর্বস্ব, অসার, তাত্ত্বিক কোন বক্তব্য ওঠে আসেনি। যেমন দেখা যায়, শেখ মুজিবের রাজনীতির ক্ষেত্রে। জনজীবনকে ধারণ করেছেন মুজিব, কথামালার বা তত্ত্বের রাজনীতিতে নিবদ্ধ হননি। গণমানুষ ছিল শেখ মুজিবের প্রাণ। যাদের তিনি দিনের পর দিন নানাভাবে সংগঠিত করেছেন। সেই মানুষ তাঁর নির্দেশে, অঙ্গুলি হেলনে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে বিজয় ছিনিয়ে এনছে। হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশ জনগণের মুখ, জনগণের আত্মা। জনপ্রাণে সঞ্চার করেছিলেন মুক্তির অমোঘ বার্তা। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন, কর্মসূচীও দিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাঙালীর জীবনকে সমৃদ্ধ করতে বৈষম্য কমাতে চেয়েছেন। জয়নুল আবেদিনও বিশ্বাস করতেন, বলেছেনও ১৯৭২ সালে, ‘সমাজতন্ত্র হোক আর যাই হোক, কেউ জাতিকে কিছু দিতে পারে না। মানুষই অর্জন করে নেয় তার নিজস্ব তন্ত্রকে এবং সাধারণ মানুষের জন্য তা অতিশয় সুশীল, সমৃদ্ধ এবং মানবিক একটি তন্ত্র। শুধু দেখতে হবে সে অর্জনের পথে বাধাগুলো যেন অপসারিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা করতে পারে।’ পাকিস্তানী আমলের ২২ বছর শেখ মুজিব ও জয়নুল আবেদিন উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের এই সময়ের জীবনেতিহাস বাঙালীর ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, বাংলার ঘরে যত ভাইবোন সবকিছুর অনুষঙ্গে জড়িয়ে গেছেন উভয়ে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে। কিন্তু কেউ কারও বিপরীতমুখী ছিলেন না। বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য কেন্দ্রিক চেতনার জাগরণ ঘটান তারা পুরো পঞ্চাশ ও ষাট দশকে। বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সঙ্কট মোচনে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন তাঁরা। দেশ ও জাতির প্রতি আত্মনিবেদিত উভয়ে আপোসহীনতার পথ ধরে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী লড়াকু বাঙালীর বৈপ্লবিক উদ্দীপনায়-জাগরণে শেখ মুজিব যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, জয়নুলের তাতেও অংশীদারিত্ব ও অবদান ছিল। সৃজনকর্মে, সাংগঠনিক কর্মক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সর্বত্রই স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদের বোধ ছিল চিরজাগরূক। পাকিস্তানী আদর্শকে তারা ১৯৪৮ সালেই জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। দারিদ্র্য, বঞ্চনা, শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন শেখ মুজিব। তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাদের জীবন সংগ্রামকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। জয়নুলও তাই। বিবেকহীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নির্দয় সামাজিক আচরণ, তীব্র সাংস্কৃতিক সংকটে বিক্ষুব্ধ। এর মধ্যে আবহমান বাংলার যে গ্রাম, প্রকৃতি, মানুষ গভীর তৃষ্ণা হয়ে চেতনায় জেগে ওঠে তাঁর, ভাঙন আর মহাদুর্ভিক্ষের শিকার। এই যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সঙ্কট তার প্রতি এক মহৎ রাজনীতিক এবং মহৎ শিল্পীর বিক্ষুব্ধ মনের ধিক্কারই হচ্ছে শেখ মুজিবের রাজনীতি ও জয়নুলের শিল্পকলার প্রাণ। শেখ মুজিব ও জয়নুল দু’জনেই কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। দেশের মানুষকে যেমন ভালবেসেছেন তেমনি তাদের জন্যই জীবন ও কর্ম উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতোই শিল্পাচার্যের মন-মানসিকতায় ছিল জন্মভূমি সচেতন স্বদেশ প্রেমিক সত্তার সুদৃঢ় ভিত্তি। দু’জনেই ছিলেন একেবারে শিকড় থেকে, অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা মানুষ। দু’জনেরই জন্মভূমি গঞ্জেÑগোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আর শিল্পাচার্য ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আমার ইউনিয়ন হলো ফরিদপুর জেলার সর্বশেষ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পাশে মধুমতি নদী। মধুমতি খুলনা ও ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করে রেখেছে।’ আর শিল্পাচার্য বলেছেন, ‘ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার পুলিশ ফাঁড়িতে আমার জন্ম। বাবা কেন্দুয়া থানার এএসআই ছিলেন। একেবারে চাষী পরিবারের লোক তাঁরা। বাবা ছাড়া তখন বংশের সবাই চাচাভূষা, জমি চাষ করে।’ তুলনায় বঙ্গবন্ধুর পরিবার শিক্ষিত ছিলেন। কয়েক পুরুষের বর্ণনা তিনি দিয়েছেনও। পিতামহদের সময় থেকে শেখ পরিবার ইংরেজী পড়াশুনা শুরু করে, মাতামহীর পরিবারও ছিল শিক্ষিত। পিতা চাকরি করতেন আদালতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কালে জন্মেছেন জয়নুল। আর যুদ্ধ শেষের সময়ে শেখ মুজিব। যৌবনকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। আর এ সময়টিতে শেখ মুজিব উপলব্ধি করলেন তার জন্মভূমির অভ্যন্তরের দারিদ্র্য, ঔপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা, ব্রিটিশদের পঞ্চাশের বা তেতাল্লিশের মন্বন্তর। ১৯৪৩ সালে যখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের সম্মেলন, সমাবেশেও যোগ দিতেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। দুর্ভিক্ষে লাখ লাধ লোক মারা যাচ্ছে। শেখ মুজিব লিখেছেন, “গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নেই, কাপড় নেই, ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নেই রাস্তায় লোক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।” শেখ মুজিবের উপলব্ধি হয়েছিল আরও যে, যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালী। যে বাঙালীর কোন কিছুরই অভাব ছিল না। সে সময়ই তাঁর মধ্যে বাঙালীর নিপীড়িত হবার পটচিত্র উদ্ভাবিত হয়েছিল। বাংলাদেশের দুরবস্থা চোখে দেখে লিখেছেন তিনি, “মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চাটা মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ এক সঙ্গে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলে মেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে।” শেখ মুজিব লেখাপাড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সে সময়। শিল্পাচার্যের মূল পরিচিতি গড়ে উঠেছে তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মধ্য দিয়ে। যেখানেই দুর্ভিক্ষ, সেখানেই শিল্পী জয়নুল। তা সেখানে যতবড় শাসকের রক্তচক্ষুই থাক না কেন। আমৃত্যু, যখনই দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তখনই তিনি পেন্সিল নিয়ে দুর্ভিক্ষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, পেন্সিলের রঙে অনাড়ম্বর, বৈচিত্র্যহীন, রংহীন নির্মম জীবনের রূপকার। দুর্ভিক্ষের এমন চিত্রমালার ভেতর দিয়েই তিনি দেশী, এমনকি বিশ্বের সব শিল্পীর মধ্যে হয়ে ওঠেন অনন্য সাধারণ, মহত্তম। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষে মানবতার যে চরম অবমাননা ঘটেছে, সেই উপলব্ধিকে চিরন্তন আবেদনবাহী করার জন্য তিনি এসব চিত্রে রূপক, প্রতীক ও সঙ্কেতের আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর এসব চিত্রকর্ম দর্শকের চোখ ও মনকে কেবল দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ও করুণ বাস্তবতার প্রতি নিবিষ্ট রাখে। কলকাতার রাজপথে নিরন্ন মানুষের যে মিছিল তিনি দেখেছেন, সেই মানুষগুলোও তার সুপরিচিত গ্রাম জীবন থেকে উন্মূলিত হয়ে খাদ্যের আশায় সেখানে ভিড় জমিয়েছে। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা তাঁকে ভারতবর্ষ শুধু নয়, দেশের বাইরেও পরিচিত করে। প্রতিবাদী এই শিল্পকর্ম সে আমলে পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হতে থাকে, আজকেও যেমন হয়। শেখ মুজিব ও জয়নুল দু’জনেই দুর্ভিক্ষের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। উভয়কেই মানুষের মৃত্যু আলোড়িত করেছিল। বিশেষত বাংলাদেশে নিরন্ন মানুষের হাহাকার তাদের স্বদেশ ও বিদেশবাসীর প্রতি মানবিক হয়ে উঠার পথ খুলে দিয়েছিল। শেখ মুজিব ও জয়নুল দু’জনেরই প্রিয় শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ। নৌকায় আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে গান শোনার বিমুগ্ধ বিবরণ, শেখ মুজিব কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করেছেন। জয়নুল তো আব্বাস উদ্দিনকে নিয়ে ‘কচিকাঁচার মেলা’র অনুষ্ঠানে দেশের নানাস্থানে গিয়েছেন। পাকিস্তানে উভয়ে সফর করেছেন, একজন রাজনীতির জন্য, অপরজন চিত্রকর্মের জন্য। কিন্তু পাকিস্তান তাদের মনে কোন সদর্থক প্রভাব ফেলেনি। বরং শোষণ বঞ্চনার ধারকদের দেখে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই হয়েছে। পাকিস্তানীদের কোন বোধই তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়নি। বিজাতীয় ধ্যানধারণাকে উভয়েই পরিত্যাগ করতে পেরেছেন অবলীলায়। শেখ মুজিব ও জয়নুল বিভিন্ন সময়ে পরস্পরের কাছাকাছি এসেছেন স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে। দেশাত্মবোধের ধারায় এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিষয়ে দেশের মানুষকে সজাগ করেছেন। বাঙালীর সামগ্রিক অর্থে চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে চেয়েছেন। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার এবং তাদের তাঁবেদারদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাঙালী চিরকাল আছে এবং চিরকাল থাকবে। শেখ মুজিবের ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন আলোড়িত করেছিল জয়নুলকে। তাদের সাধক জীবন জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল মুক্তির বার্তা নিয়ে। শেখ মুজিব উপাধি পেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ আর জয়নুল হলেন ‘শিল্পাচার্য’। স্বদেশবিমুখ না হওয়া জয়নুল ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা ও মুক্তির সপক্ষে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। ‘বাংলা চারু ও কারু শিল্পী সংসদ’ গঠন করে ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক প্ল্যাকার্ড বহন করেছেন। বর্জন করেছেন পাকিস্তানীদের প্রাপ্ত খেতাবও। বিজয়ী বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এঁকেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চিত্র। মুজিব ছিলেন রাজনীতির কারিগর ও জয়নুল শিল্পী গড়ার। দুজনই তৈরি করেছন অনেক কৃতীমানকে। বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্প সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছিলেন জয়নুল। সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্যকে জমি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। শিল্পাচার্যও সেখানে তার স্বপ্নের জাদুঘরটি গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় মুষড়ে পড়েছিলেন শিল্পাচার্য। তখন তিনি নিজেও অসুস্থপ্রায়। ৯ মাস পর ১৯৭৬ সালে ২৮ মে তিনি তাঁর প্রিয় বাংলাকে ছেড়ে যান। কিন্তু রেখে গেছেন অমর কীর্তিসমূহ। জন্মশতবর্ষে তার গড়া প্রতিষ্ঠান ও চিত্রকর্মগুলো নতুন করে প্রেরণা যোগাবে শতাব্দী থেকে শতাব্দী শেখ মুজিবের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে।
×