ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একটি বই, একটি ইতিহাস এক বিস্মৃত গণহত্যার দলিল

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ১ জানুয়ারি ২০১৫

একটি বই, একটি ইতিহাস এক বিস্মৃত গণহত্যার দলিল

গত ২১ নবেম্বর কানাডার সর্বাধিক পঠিত দৈনিক টরন্টো স্টারএ একটি খবরের শিরোনামটা ছিল এ রকম : ‘ঐতিহাসিক বই ৭৫,০০০ ডলার পুরস্কার পেল।’ বিস্তারিত খবর ছিল এ রকম : ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যায় আমেরিকার যোগসাজশ নিয়ে লেখা বইটি কান্ডিল পুরস্কার পেয়েছে যার মূল্য ৭৫,০০০ আমেরিকান ডলার। ‘ঞযব ইষড়ড়ফ ঞবষবমৎধস : ঘরীড়হ, করংংরহমবৎ, ধহফ ধ ঋড়ৎমড়ঃঃবহ এবহড়পরফব’ নামের বইটির লেখক টরন্টোতে বেড়ে ওঠা প্রিন্সটন অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস কিভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সামরিক একনায়ক নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের গোপন সমর্থনে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল তার দালিলিক তথ্য তুলে ধরেছেন বইটিতে। ১৭৫টি বইয়ের ভেতর থেকে প্রতিযোগিতায় এ বইটি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসিত এ পুরস্কারের ৫ জন বিচারকের (যাদের তিনজন আমেরিকান) বিচারে প্রথম পুরস্কার অর্জন করে। টরন্টোতে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করে অধ্যাপক ব্যাস বলেন, ‘জনগণ শীতল যুদ্ধের সময়কার এ অধ্যায় জেনে উপকৃত হবে। প্রতিটি পাঠক তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের সে সময়ের কার্যাবলীর বিচার করবেন। এটা আমার কাজ নয়, তাঁরা এর থেকে কী গ্রহণ করবেন সেটা নির্দেশ করার; কিন্তু তাঁদের অন্তত সত্য জানা উচিত এবং সেটা জানার পরেই শুধু আমরা সত্যিকার বিতর্ক করতে পারি। হার্ভার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত অধ্যাপক গ্যারি ব্যাসের ভাষায়, ‘এ বইটা হলো পৃথিবীর দুই বৃহত্তম গণতন্ত্র, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ানক মানবিক সঙ্কটে একে অপরের সঙ্গে কিভাবে সম্মুখীন হয়েছে সেটা নিয়ে। সে হত্যাযজ্ঞ, যেটা সংঘটিত হয়েছিল এখনকার বাংলাদেশ, সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক মুখ্য নৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যদিও আজ এটা আমেরিকানদের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। আধুনিকযুগের হিংস্রতার অন্ধকার কাহিনীতে এটা বসনিয়ার তুলনায় অধিকতর রক্তক্ষয়ী এবং অনেকটা রুয়ান্ডার সমকক্ষ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এ ঘটনা ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ওপর, যেখানে একষষ্ঠ মানবজাতি বাস করে, পর্বতসম প্রভাব ফেলেছিল।’ বইটির শিরোনাম এসেছে ১৯৭১ সালে ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড, পাকিস্তানের ভয়ানক প্রচারাভিযানের সময় ঢাকা থেকে বাংলাদেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছিল, তার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি এবং তাঁর ঢাকাস্থ সহকর্মীবৃন্দ একের পর স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে টেলিগ্রামগুলো পাঠান তার ওপর ভিত্তি করে। এ টেলিগ্রামসমূহকে অবশ্য হোয়াইট হাউস কোন ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি তাদের নীতি-নির্ধারণে, যে নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রতি নিক্সনের ঘৃণা- যেটা একটি গণতান্ত্রিক ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের সামরিক একনায়কের সঙ্গে ভদ্র থাকার নীতি, (‘আমি তাদের ওপর প্রস্রাব করতে চাই’, এ ধরনের মন্তব্য নিক্সন করেছেন ভারতের নেতৃত্বের সম্পর্কে)। আর্চার ব্লাড এবং তাঁর ২০ জন ঢাকাস্থ সহকর্মী ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে টেলিগ্রামটি পাঠান যার শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপারে আমেরিকান নীতির মতদ্বৈধতা’ এবং এটা সম্ভবত কূটনীতির ইতিহাসে মার্কিন বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে তার নিজের দেশের কূটনীতিকদের সবচেয়ে কড়া প্রতিবাদ। এর সারসংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ: ‘আমেরিকা আজকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করছে এটা আমাদের জাতীয় এবং নৈতিক স্বার্থ কোনটার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলেটের অফিসার আমরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করছি। আমাদের সরকার গণতন্ত্রকে দলিত করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার যা করছে তাকে অনেকেই ‘নৈতিক দেউলিয়াপনা’ বলে আখ্যায়িত করবেন, বিশেষ করে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়াহিয়াকে বার্তা পাঠিয়েছে গণতন্ত্রকে সমর্থন করে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে (ঘটনাক্রমে তিনি পাশ্চাত্যপন্থী) ও রক্তপাত এবং দমননীতি বন্ধের দাবি জানিয়ে অথচ আমরা হস্তক্ষেপ করছি না, এমনকি নৈতিকভাবেও না, যেখানে সোজা কথায় ‘গণহত্যা’ চলছে, এ অজুহাতে যে এটা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বহু প্রাইভেট আমেরিকানও ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। আমরা পেশাদার সরকারী কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান নীতির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জানাচ্ছি এবং আকুলভাবে আশা করছি আমাদের সত্যিকার এবং স্থায়ী স্বার্থ যাতে রক্ষা হয় সে উদ্দেশ্যে নীতি পরিবর্তিত হবে এবং আমাদের দেশ যে মুক্ত দুনিয়ার নৈতিক নেতা সেটা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবে।’ প্রফেসর ব্যাস সদ্য শ্রেণীবিন্যস্ত (পষধংংরভরবফ) থেকে মুক্ত এমন নথি, নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের কথোপকথনের রেকর্ডকৃত টেপ এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের ওপর নির্ভর করে এ ইতিহাস লিখছেন। কিন্তু প্রফেসর ব্যাস তাঁর এ বিবরণ অসম্পূর্ণ বলে সতর্ক করেছেন। ‘হোয়াইট হাউস কর্মীরা নিয়মিতভাবে তাঁদের রেকর্ড ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করেছেন, ‘তিনি লিখেছেন, ‘এমনকি এখনও জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অনেক কিছু গোপন রাখা হয়েছে।’ হেনরি কিসিঞ্জার একটি সাক্ষাতকারের জন্য প্রফেসর ব্যাসের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার দ্বারা প্রকাশ করা কিছু বিতর্কিত মতামত উদ্ধৃত করে লেখক ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রকৃত ঘটনার একটি বিস্তারিত ওভারভিউই শুধু তুলে ধরেননি, কিন্তু তিনি দক্ষিণ এশিয়ার মানবিক সঙ্কটের প্রতি আমেরিকান মুখপাত্রদের অনুযোগ্য মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর অর্থ হলো ইয়াহিয়ার মতন একজন নিরর্থক অসার এবং মধ্যম শ্রেণীর মানুষ, তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যা ইচ্ছে তাই করুন না কেন, হঠাৎ করে তিনি আমেরিকার কাছে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হলেন। হোয়াইট হাউস তার চোখ বন্ধ করে রাখল এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শত শত এবং হাজার হাজার বাঙালী হত্যা করল এবং ১ কোটি মানুষকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করল। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার তাঁদের নিজস্ব কূটনীতিকদের দ্বারা লিখিত তার বার্তা, যেখানে বলা হলো পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ‘গণহত্যা’ পরিচালনার জন্য দোষী, আমলে নিলেন না। তাঁরা পাকিস্তানে আমেরিকান অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং খুচরা যন্ত্রাংশ পাঠানো বন্ধ করতে অস্বীকার করেছেন- যে অস্ত্র দ্বারা পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। উপরন্তু পাবলিক বা প্রাইভেট- কোনভাবেই হোয়াইট হাউস শুধু ইয়াহিয়াকে নিন্দা করতে অস্বীকার করেননি প্রকৃতপক্ষে, নিক্সন প্রকৃত স্নেহের সঙ্গে একনায়কে গণ্য করতেন এবং ‘একটি শালীন মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করতেন। তিনি ইয়াহিয়াকে জানান, ‘আপনি এ কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্মুখীন হতে যে কঠিন যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন সেটা আমি অনুধাবন করি।’ কিসিঞ্জার এবং নিক্সনের কথোপকথন, যেটা লেখক টেপ থেকে উদ্ঘাটন করেছেন, সেটা বইয়ের সবচেয়ে জঘন্য দিক। ভারত এবং তার জনগণের ব্যাপারে নিক্সন এবং কিসিঞ্জার যেমন অত্যন্ত আপত্তিকররূপে অভদ্র এবং ঘৃণা প্রকাশ করেছেন সেটা অভাবনীয়। ‘দুশ্চরিত্র এবং অজন্মা’ ছিল তাদের ভারতীয় নেতা এবং জনগণকে অভিহিত করার ভাষা। ভারতে বিপুল জনসংখ্যার কথা যখন তাকে জানানো হয় (তিনি প্রকৃত সংখ্যা জানতেন না) তখন তাঁর মন্তব্য : ‘ঐ নরকে আবার কে মানুষ জন্ম দেয়।’ এমনকি তিনি ভারতকে অভিশাপ দিয়েছেন এই বলে, ‘ভারতের প্রয়োজন... তারা সত্যিই... কী কী প্রয়োজন’ কিসিঞ্জার নিক্সনের কথার মাঝখানে বললেন, ‘তারা যেমন বেজন্মাদের হয়। নিক্সন শেষ করলেন এই বলে তাদের দরকার, ‘একটি ভর দুর্ভিক্ষ।’ তেমনি তিনি বাঙালীদের বলেছেন, ‘একটি গুচ্ছ বাদামী মুসলমান।’ ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং যখন নিক্সনকে ভারতে এক কোটি বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যার কথা হোয়াইট হাউসে এসে বললেন, ‘কেন ভারত ওদের আসা বন্ধ করার জন্য গুলি করে না’- এ ছিল নিক্সনের সমস্যা সমাধানের শ্লেষাত্মক উপদেশ। নিজের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে, নিক্সনের বিশেষ করে ঘৃণার মানুষটি ছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। ব্লাড টেলিগ্রামের ওপর ভিত্তি করে এবং ভারত ঘুরে এসে, কেনেডি মার্কিন অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার নিন্দামূলক এবং হত্যা বন্ধ করার জন্য নিক্সন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তিনি বললেন, ‘বাঙালী নেতার একমাত্র অপরাধ তিনি এক নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।’ উদ্বাস্তু শিবিরের মানবিক দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখে এসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর আবেগময় প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেন কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি, ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির...’-এর ইংলিশ অনুবাদে, ‘যিবৎব ঃযব সরহফ রং রিঃযড়ঁঃ ভবধৎ ধহফ যবধফ রং যবষফ রং যরমযৃ’. কেনেডির এ ভাষণকে উল্লেখ করে ভারতের ওহফরধহ ঊীঢ়ৎবংং তাঁকে অভিহিত করলেন, ‘আমেরিকার বিবেকের কণ্ঠস্বর’ বলে।
×