ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পিলখানায় বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ॥ ১৩৭ ফাঁসির আসামির আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ জানুয়ারি ২০১৫

পিলখানায় বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ॥ ১৩৭ ফাঁসির আসামির আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শ

আরাফাত মুন্না ॥ পিলখানায় চাঞ্চল্যকর বিডিআর হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১৩৭ আসামির আপীল এবং রাষ্ট্রপক্ষে মৃত্যুদ- অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) বিষয়ে শুনানি শুরু হচ্ছে শীঘ্রই। ইতোমধ্যে শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় পেপারবুকও (মামলার নথিসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র সংবলিত বই) প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো সুপ্রীমকোর্টের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ছাপা হয়েছে পেপারবুক। সম্প্রতি শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় ৩৩ কপি ও অতিরিক্ত ২ কপিসহ সর্বমোট ৩৫ কপি পেপারবুক মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। যার প্রতি কপিতে ৩৭ হাজার পৃষ্ঠা রয়েছে। সাধারণ নিয়মে বিজিপ্রেসে এই পেপারবুক তৈরি করা হলে কয়েক বছর সময় লাগত বলে সুপ্রীমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, এখন থেকে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর পেপারবুকও সুপ্রীমকোর্টেই ছাপা হবে। সুপ্রীমকোর্টের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেপারবুক প্রস্তুত করার বিষয়টি ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক হিসেবে থাকবে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর দেয়া এ রায়ে ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল আদালত। তবে এর মধ্যে ১৪ পলাতক এবং বন্দী অবস্থায় একজন মারা যাওয়ায় আপীল করেছে ১৩৭ আসামি। সুপ্রীমকোর্টের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, শীতকালীন অবকাশের পর আগামী ৫ জানুয়ারি সুপ্রীমকোর্ট খোলার দিনই বহুল আলোচিত এই মামলাটির আপীল ও ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপর প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই নির্ধারিত এক বা একাধিক হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শুরু হবে এই চাঞ্চল্যকর মামলাটির। সাধারণ নিয়মে, নিম্ন আদালত থেকে কোন মামলায় মৃত্যুদ- দিলে, তা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণ) মামলা হিসেবে হাইকোর্টে আসবে। এ ক্ষেত্রে দ-িত আসামি আপীল না করলেও ওই মামলা হাইকোর্টে আসতে কোন বাধা নেই। হাইকোর্টে এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার পরও যদি মৃত্যুদ- বহাল থাকে এবং দ-িত ব্যক্তি যদি সুপ্রীমকোর্টে আপীল না করে তাহলে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে। সুপ্রীমকোর্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব মামলার শুনানিতে প্রধান বাধা পেপারবুক প্রস্তুত করা। কারণ মামলার সব কাগজপত্র, সাক্ষী-সাবুদ, এফআইআর ও রায় সংকলিত করে পেপারবুক তৈরি হয় সরকারী বিজি প্রেসে। তবে বিজি প্রেসে কোন মামলার সমস্ত নথি পাঠানোর পরও ছাপা শুরু করতে প্রায় এক বছর সময় নেয় তারা। এর পর আবার অন্যান্য মামলার চাপে ডেথ রেফারেন্সের একটি মামলার নিষ্পত্তিতে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লাগে। উল্লেখ্য, বর্তমানে হাইকোর্টে ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের ডেথ রেফারেন্সের মামলাগুলোর শুনানি হচ্ছে। এদিকে, ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলার রায় দেন আদালত। এই রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এক মামলায় এত আসামির মৃত্যুদ- হয়েছে এমন আর কোন নজির নেই। আলোচিত এই মামলাটি নিম্ন আদালত থেকে রায় দেয়ার পর নিয়মানুযায়ী হাইকোর্টে আসে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে। একই সঙ্গে মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের আপীল তো রয়েছেই। তবে সিরিয়াল অনুযায়ী এ মামলার কার্যক্রম শুরু হলে শুনানি শুরু হতেই পাঁচ বছরেরও বেশি সময় লাগার আশঙ্কায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রীমকোর্ট। পরে এই মামলার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পেপারবুকও সুপ্রীমকোর্টের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কারণ বিজিপ্রেসে এই পেপারবুক মুদ্রণে দুই থেকে তিন বছর লাগতে পারে। পরে পেপারবুক মুদ্রণের জন্য তিনটি অত্যাধুনিক ডিজিটাল ডুপ্লিকেটর মেশিন আনা হয় সুপ্রীমকোর্টে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই তিনটি মেশিনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইসলাম এন্টারপ্রাইজ মেশিনগুলো গত বছরের ২ এপ্রিল সুপ্রীমকোর্টে রেজিস্ট্রারের অফিসে জমা দিয়েছে। এই মেশিন মিনিটে ১৫০ পৃষ্ঠা মুদ্রণে সক্ষম। সুপ্রীমকোর্ট সূত্র জানায়, মামলার সকল নথিপত্র কম্পিউটারে কম্পোজ শেষ হলে গত বছরের ৪ নবেম্বর থেকে এই পেপারবুক মুদ্রণ শুরু হয়। হাইকোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোঃ আজিজুল হকের তত্ত্বাবধানে সুপ্রীমকোর্টের ২৫ থেকে ২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছুটির দিনসহ প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এই মুদ্রণ কাজ করেছে। এই পেপারবুক দ্রুত প্রস্তুত করতে শেষের দিকে সারারাত কাজ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার এস এম কুদ্দুস জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের মামলার আপীল শুনানি করতে প্রয়োজনীয় পেপারবুক ছাপাটা অনেক বড় একটা কাজ ছিল। প্রধান বিচারপতির দিক নির্দেশনায় এবং সরকারের সহযোগিতায় মামলার পেপারবুক তৈরির এই বিশাল কর্মযজ্ঞ আমরা শেষ করতে পেরেছি। তিনি বলেন, বিজি প্রেসে এই কাজ করতে কয়েক বছর সময় লাগত। তবে আমরা মাত্র কয়েক মাসেই এই কাজ শেষ করেছি। কুদ্দুস জামান বলেন, আমরা অফিসিয়ালি ৩৩ কপি ও অতিরিক্ত ২ কপি মোট ৩৫ কপি পেপারবুক তৈরি করেছি। প্রতিটিতে ৩৭ হাজার পৃষ্ঠা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই কাজে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। সরকার আমাদের বিশেষ বরাদ্দ দেয়ায় আমরা প্রিন্টিং মেশিন কিনতে পেরেছি। মেশিন আনার পর আমরা দিন রাত কাজ করে এই কর্মযজ্ঞ শেষ করতে পেরেছি। এ কাজের অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদও জানান তিনি। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর রায় দেন ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত। রায়ে ১৫২ বিডিআর জওয়ানকে মৃত্যুদ-, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন এবং আটক ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে পলাতক ১৪। এর মধ্যে বন্দী অবস্থায় একজন মারা গেছেন। বাকিদের আপীল এবং মৃত্যুদ- অনুমোদনের বিষয়ে করা আবেদনের শুনানি হবে হাইকোর্টে।
×