ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাদাসিধে কথা ॥ নতুন বছরের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২ জানুয়ারি ২০১৫

সাদাসিধে কথা ॥ নতুন বছরের স্বপ্ন

অনেকদিন থেকে একটা পারিবারিক প্রোগ্রাম ছিল, পরিবার এবং বৃহত্তর পরিবারের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার সেন্টমার্টিন বেড়াতে যাব। ঠিক রওনা দেয়ার আগে আমার ছোট বোন ফোন করে আমাকে খবর দিল একটা ছোট শিশু একটা গভীর গর্তে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে একটু খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায় তাই গভীর গর্তে নিশ্চয়ই পানি থাকবে, যে সব গর্ত ব্যবহার হয় না সেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হয় তাই সেখানে মানুষ পড়ে গেলে বেঁচে থাকার কোন আশা থাকে না। কিন্তু এই শিশুটির বেলায় একটু আশার খবর আছে যে তার সঙ্গে নাকি কথা বলা হয়েছে, তাকে জুস খেতে দেয়া হয়েছে। সারারাত ধরে বাস চলেছে, আমি গভীর রাত পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছি। সাংবাদিকরা সবার আগে খবরটা পেয়ে যাবে বলে তাদের ফোন করেছি। চারদিকে কত রকম মন খারাপ করা খবর তার মাঝে যদি এই শিশুটিকে উদ্ধার করে ফেলা যায়, তার মুখের একটা হাসি যদি দেশের মানুষ দেখতে পারে এক মুহূর্তে পুরো দেশের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। আমি সেই হাসিটির জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো দেশের মানুষের মন ভাল হলো না, গভীর বিষাদে সবার মন ভেঙ্গে গেল, শিশুটিকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা হলো, কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় নয়, মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সে দেশের সবার মন ভাল করে দিতে পারল না। শুধু তাই নয়, তার আগে আরও মন খারাপ করা খবর আছে পুরো বিষয়টাই একটা গুজব এবং সেই গুজব ছড়ানোর জন্য শিশুটির বাবাকে আটক করা হয়েছে, অন্য শিশুদেরও আটক করা হয়েছে এ রকম খবরও পেয়েছি। এই গর্তে আসলে শিশুটি নেই সেজন্য উদ্ধার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেটাও শুনেছি। যখন কেউ মারা যায় তখন আপনজনরা একে অন্যের পাশে থেকে দুঃখটা ভাগাভাগি করে নেয়। এখানেও তাই হয়েছে। দুঃখটা পুরো দেশের মানুষ ভাগাভাগি করে নিয়েছে, গভীর ভালবাসা দিয়ে এই ছোট শিশুকে বিদায় দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র দফতর কিংবা পুলিশের হৃদয়হীন বক্তব্য কিংবা আচরণে সাধারণ মানুষ যে রকম ক্ষুব্ধ হয়েছে, দুঃসময়ে তরুণদের এগিয়ে আসার সেই অসাধারণ ভূমিকা দেখে আবার মানুষের ওপর বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। আমরা অসংখ্যবার এই বিষয়টি দেখেছি, ঠিক যখন দরকার হয়েছে তরুণরা এগিয়ে এসেছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় বিভাগ, বড় বড় অধ্যাপক, তাদের ছাত্রছাত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে একটা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হতে পারে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ একেবারেই তাদের নিজস্ব একটা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হতে পারে। সবাই যখন হাল ছেড়ে দেয় তারা হাল ছাড়ে না। এই অসাধারণ বিষয়টি সম্ভবত আমাদের রক্তের ভেতর আছে, এই কারণেই মনে হয় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে একটি দেশ পেয়েছিলাম। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমাদের দেশ কখনও তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যটুকু পায় না। দেশকে চালিয়ে নেয়, যাদের আমরা বলি সাধারণ মানুষ তারা তাদের ভালবাসা আর আন্তরিকতায় এই দেশটি টিকে আছে। আমাদের এই তরুণ সমাজকে আমার সেল্যুট। যখন রানা প্লাজা ধসে পড়েছিল তখন আরেকবার আমরা এই তরুণ প্রজন্মের অসাধারণ ভূমিকা দেখেছিলাম। আমার মনে আছে আমি তখন তরুণ সেই স্বেচ্ছাসেবকদের এমন কিছু ভূমিকার কথা শুনেছিলাম যেটি বিশ্বাস করা কঠিন। আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখি, কিন্তু আমি জানি সেই স্বেচ্ছাসেবকদের অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো যদি আমি হুবহু লিখি কেউ সেগুলো সত্যি বলে বিশ্বাস করবে না। সবারই নিশ্চয়ই মনে আছে অসংখ্য শ্রমিকের হাত পা ভাঙ্গা কংক্রিটের নিচে চাপা পড়েছিল, তাদের বাঁচানোর একটিমাত্র উপায় সেই কংক্রিটে আটকাপড়া হাত কিংবা পা কেটে বাকি মানুষটিকে নিয়ে আসা। সেই ভয়ঙ্কর সার্জারি কারা করেছিল? আমি জানি সারা পৃথিবীর কোন মানুষ বিশ্বাস করবে না যে এই দেশের কিছু তরুণ যারা জীবনে এ ধরনের কোন কাজ করেনি। তারা সেই অবিশ্বাস্য সার্জারি করেছিল। তাদের হাতে বেদনানাশক ইনজেকশনের একটা সিরিঞ্জ আর একটা হ্যাক স (ধাতব জিনিস কাটার উপযোগী করাত) দিয়ে দেয়া হতো। তারা সেই ইনজেকশন দিয়ে হাত কিংবা পা কেটে মানুষটিকে ছুটিয়ে এনেছে। তারপর তাদের ঘাড়ে করে ধসে পড়া সেই রানা প্লাজার ফাঁকফোকর দিয়ে বের করে এনেছে। পুরো ভবনটি ছিল একটা বিপজ্জনক জায়গা, ধসে পড়া অংশগুলো নড়ছিল, যে কোন মুহূর্তে আরও ধসেপড়ার আশঙ্কা ছিল। অন্ধকার সেই মৃত্যুপুরীর বিভীষিকা থেকে তরুণরা একজন একজন করে শ্রমিককে মৃত্যুর অন্ধকার থেকে জীবনের আলোতে নিয়ে আসছিল। সবাইকে আনতে পারেনিÑ অনেক শ্রমিক এমন জায়গায় আটকা পড়েছিল যেখান থেকে তাদের কোনভাবেই উদ্ধার করে আনা সম্ভব ছিল না। সেই তরুণরা তাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করেছেÑ তারা যখন একজন একজন করে মারা গিয়েছে সেই অন্ধকার কুঠরিতে তরুণরা তাদের পাশে থেকেছে। আমি সেই দৃশ্যগুলোর কথা চিন্তা করতে পারি না। সেই অসাধারণ তরুণদের আমি মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাই। শিশু জিহাদের বেলাতেও আমরা সেই একই ধরনের তরুণদের দেখেছি। এই রাষ্ট্রযন্ত্র ‘তুচ্ছ’ একটি শিশুর জীবনকে উপেক্ষা করে পুরো বিষয়টুকুতে সরকারের ভাবমূর্তিকে উদ্ধার করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অতীতের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঐতিহ্যকে ধরে রেখে যখন তারা একইভাবে হুদয়হীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন এই তরুণরা সবকিছু ভুলে সেই শিশুটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে গেছে। আমরা শিশু জিহাদকে জীবিত ফিরে পাইনি, কিন্তু তার দেহটি উদ্ধার করার কারণে তাকে সম্মানজনকভাবে শেষ বিদায় দেয়া গেছে, তার আপনজনদের অসম্মান থেকে উদ্ধার করে শিশুটির জন্য শোক করার একটি সুযোগ করে দেয়া গেছে। এই লেখাটি যখন প্রকাশ পাবে তখন আমরা নূতন বছরে পা দেব। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সবাইকে নূতন বছরের নূতন কোন স্বপ্ন দেখিয়ে কিছু লিখব। কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে মনে হলো যে দেশে আমাদের এই তরুণরা আছে সেই দেশের মানুষের কী আলাদা করে নূতন কোন স্বপ্ন দেখতে হয়? এই তরুণরাই কী আমাদের স্বপ্ন নয়? ৩১.১২.১৪
×