ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এক বিস্মৃত গণহত্যার দলিল

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২ জানুয়ারি ২০১৫

এক বিস্মৃত গণহত্যার দলিল

( শেষাংশ) কেনেডির ভারত সফরকালে তাঁকে যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের থেকেও বেশি মর্যাদা দেয়া হয় সেটাও নিক্সনকে ভারতের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। সারাটা সঙ্কট সময়ে, কেনেডি এবং তাঁর দলীয় সিনেটররা ছিলেন নিক্সন-কিসিঞ্জারের খলনায়ক। সারাটা সঙ্কট সময়ে মুজিব এবং বাংলাদেশ ছিল সমর্থক। বাংলাদেশ সমস্যার যে কোন রাজনৈতিক সমাধানের কথা উঠলেই মুজিবের নামই উঠে এসেছে বার বার। শ্রীমতী গান্ধীসহ বিশ্ব নেতারা যখনই রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন, তখনই এসেছে মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার। একপর্যায়ে নিক্সন কিসিঞ্জারকে এ সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এটা হবে ইয়াহিয়ার জন্য আত্মঘাতী। এটা করতে গেলে তাঁর ক্ষমতাচ্যুতি ঘটবে।’ ভারতে আশ্রয় নেয়া মুজিব হতেন একজন কাপুরুষ যিনি জনগণকে বিপদে ফেলে পালিয়ে গিয়েছেন, যেহেতু একমাত্র মুজিবই ছিলেন সেদিনের বাংলাদেশের মানুষের কাছে কিংবদন্তির মহানায়ক অথচ পাকিস্তানের কারাগারে মুজিব ছিলেন সামরিক জান্তার গলার কাঁটা। ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিযুক্ত আসামির বিচারে অবধারিত ফাঁসিকাষ্ঠের কথা জেনেও তিনি ছিলেন তাঁর চিন্তার দৃঢ়তায় এবং বিশ্বাসে অবিচল। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালী জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। শ্রীমতী গান্ধী ৩ নবেম্বর নিক্সনের সঙ্গে যখন হোয়াইট হাউসে সাক্ষাত করেন তখন একে অন্যের প্রতি চরম ঘৃণারই বহির্প্রকাশ ঘটে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা যখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মুজিবের জয়লাভের কথা বলছিলেন তখন নিক্সন গত কয়েক মাসে ইয়াহিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ‘হৃদয়গ্রাহী পদক্ষেপের’ কথা বলছিলেন। দ্বিতীয় সাক্ষাতের আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এক ঘণ্টা হোয়াইট হাউসে অপেক্ষায় রাখা হয়। নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের সমস্ত সঙ্কটকালের কথোপকথন সম্ভবত বিশেষজ্ঞদের অবাক করেনি, তবে তাঁদের কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে তার ফলাফল যে কী হবে এবং সে অবস্থায় বাংলাদেশের জন্ম যে অবধারিত সেটা আমেরিকার সশস্ত্রবাহিনীর প্রধানদের চেয়ারম্যানসহ এবং কিসিঞ্জার ও অনেক স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনেক উপদেষ্টা উপসংহার টানলেও শুধু ভারতের প্রতি চরম ঘৃণার কারণে বাংলাদেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া ইসলামিক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের ‘মদ খেয়ে চুর’ হয়ে থাকা একনায়কের প্রতি নিক্সনের ভালবাসা এবং সমর্থনের বিন্দুমাত্র কমতি ঘটেনি। এমনকি আমেরিকার আইন ভেঙ্গেও ইরান, জর্ডান এবং তুরস্ককে বলেছেন পাকিস্তানে যুদ্ধবিমান পাঠাতে। এই আস্কারাতেই ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে বসল। যৌথবাহিনী যখন নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন নিক্সন এবং কিসিঞ্জার যে কতটা বেপরোয়া এবং অদূরদর্শী তার প্রমাণ মেলে তাঁদের বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর মধ্য দিয়ে। এটা এতদিন সম্পূর্ণ অজানা ছিল যে কিসিঞ্জার এমনকি একটি সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য ভারতীয় সীমান্তে সৈন্য সরাতে চীন উৎসাহ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন আক্রমণ করে তবে সে অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না বলে নিক্সন কিসিঞ্জারকে আশ্বস্ত করেন। সৌভাগ্যবশত, দুই কমিউনিস্ট দেশের নেতারা হোয়াইট হাউসের তুলনায় আরও প্রশান্ত এবং দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক সেটা প্রমাণিত হয় এবং বিশ্বকে তাঁরা একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করেন। ১৬ ডিসেম্বর যখন তাঁদের প্রিয় ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ঢাকায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন হোয়াইট হাউসে হাহাকারের যে দৃশ্যের বর্ণনা অধ্যাপক ব্যাস দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে এ যুদ্ধে ইয়াহিয়া নয়, নিক্সনই পরাজয় বরণ করেছেন। আত্মসমর্পণের পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর যখন শ্রীমতী গান্ধী পশ্চিম সেক্টরে একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, সে খবর পেয়ে কিসিঞ্জার নিক্সনকে চাঙ্গা করার জন্য টেলিফোন করেন, ‘অভিনন্দন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’ উপসংহারে অধ্যাপক ব্যাস লিখছেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত একজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় বিগত দুই দশকের সবচেয়ে বড় গণপ্রতিবাদ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের জনগণ কি গভীরভাবে ১৯৭১ সালের বিভীষিকাকে হৃদয়ে ধারণ করছে। তাদের রাজনীতি তারা কিভাবে সমাধান করবে সেটা বাংলাদেশের জনগণের ব্যাপার, কিন্তু আমেরিকানদের বুঝতে হবে প্রথম থেকেই এ দূরবর্তী মানুষদের কাজকে দুরূহ করছে ১৯৭১ সালের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বীভৎসতা। কিসিঞ্জারের বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া যদি বেশি আশা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের জন্য এটা হবে এক শিষ্টতার পদক্ষেপ, যদি সে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাঁদের সরকারের করা অন্যায়কে সংশোধন করাকে তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।’ নিয়তির পরিহাসে ১৯৭৪ সালের ৭ আগস্ট হোয়াইট হাউস থেকে বিতাড়িত নিক্সন নিজেকে পুনর্বাসিত করার জন্য ১০টা বই লিখেছেন, যার কোনটাতেই তিনি তাঁর সমর্থনে পাকিস্তানী জেনারেলরা তাদের ‘নিজেদের’ জনগণের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে সেটার উল্লেখ করেননি। যেটাকে নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি বইয়ের লেখক বব উডওয়ার্ড বলেছেন, ‘ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে।’ নিক্সন এবং কিসিঞ্জার ওয়াটারগেট, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়াতে তাঁদের দুষ্কর্মের কথা জনগণের কাছ থেকে ঢাকতে পারেননি, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ওপর নিক্সন কিসিঞ্জারের সমর্থনে ‘দূরবর্তী গরিব বাদামী’ মানুষদের ওপর সংঘটিত গণহত্যার কাহিনী খুব কম আমেরিকানই মনে রেখেছে। নিউইয়র্ক টাইম্সের ডেক্সটার ফিল্কিন্সের ভাষায়, ‘আশ্চর্যজনকভাবে... নিক্সন এবং কিসিঞ্জার অফিস ত্যাগ করার পরেও নিজেদের বিরাট রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছেন। এ বইটা ওই অভিধা তাদের জন্য যে কতটা অপ্রযোজ্য সেটা প্রমাণ করে এক অসাধ্য সাধন করেছে।’ বইটি বাঙালীদের জন্য শুধু তাদের নিজের জাতিসত্তার জন্মের এক ইতিহাসই নয়, এটা তাদের ওপর পরিচালিত মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যার এক তথ্যচিত্র। এটা খুবই একটা দুঃখজনক ব্যাপার, নিরস্ত্র মানুষের ওপর পরিচালিত ভয়ঙ্কর গণহত্যার একজন স্বৈরাচারী একনায়কের সঙ্গে যোগসাজশ করেছে টমাস জেফারসনের আমেরিকা। আমরা কয়েক দশক ধরে বিশ্বকে এ গণহত্যার কথা বলে আসছি। এ বইটির ঐতিহাসিক সাহিত্যে কানাডা ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে ঈপ্সিত কান্দিল পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে উজ্জ্বলরূপে এর বিষয়বস্তুর সত্যবাদিতা অনুমোদিত হয়েছে। অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস আপনাকে ধন্যবাদ প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য, যেটা সত্য আমরা সমস্ত বিশ্ববিবেককে গত চার দশক ধরে বলে আসছি। পাদটীকা : যারা ইতোমধ্যেই ‘ইতিহাস’ লিখেছেন বা ভবিষ্যতে ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করছেন তাঁদের জন্য এ বইটি অবশ্যই পঠনীয়। ব্যক্তিগত অনুভূতি ইতিহাসের উপপাদ্য হতে পারে না। ইতিহাস হলো প্রামাণ্য দলিল। জনসভায় উপিস্থিত না থেকেও নিযুত মানুষের উপস্থিতিতে দেয়া বক্তব্যের এক ঐতিহাসিক সত্যকেই মানসিক অসুস্থ মানুষের মতন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে কিছু নিন্দুকের বাহবা পাওয়া গেলেও ঐ ‘ইতিহাসবিদকেই’ পরিশেষে ইতিহাসেরই আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। আর যাঁরা প্রকাশ্য জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ‘কম রক্তক্ষয়ে’ স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখান তাঁরা বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া নয়। একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের একচ্ছত্র সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘের ১১৫টি রাষ্ট্রের ১০৪টি আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, যদিও সারাবিশ্বে মুজিব মানেই ছিল বাংলাদেশ আর তাঁর সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতাকামী জনগণ। আর নিরাপত্তা পরিষদে তিন তিন বার সোভিয়েত ভেটো রক্ষা করেছিল আমাদের চূড়ান্ত বিজয়কে। ৭ মার্চে জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুজিব হয়ত ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামক ওয়ান ম্যান পার্টির সভাপতি হয়ে থাকতেন, বাঙালী জাতির পিতা হতেন না। আর এ সমস্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন আবর্জনা পত্রিকায় ছেপে কি আমাদের সম্পাদক সাহেবরা কী ধরনের সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেন সেটা নিয়ে সংশয় থাকাটাই স্বাভাবিক। ৫০০ পৃষ্ঠার বইটির কোথাও লন্ডনে পলাতক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ভাষায় ‘সন্ত্রাস আর দুর্নীতির প্রতিবিম্ব’ নয়া ‘ইতিহাসবিদ’এর পিতা বাংলাদেশের ‘প্রথম প্রেসিডেন্ট’ বা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’, যার ঘোষণা না হলে নাকি দেশ স্বাধীনই হতো না, তাঁর নাম নিক্সন-কিসিঞ্জার সাহেবরা একবারও উল্লেখ করলেন না এবং যাঁর নাম অধ্যাপক ব্যাস সাহেব একবার ভুলেও উল্লেখ করলেন না। তাঁকে কোন উপদেশ দিচ্ছি না, কারণ এ বইটি পড়ার মতন যোগ্যতা অর্জন করতে হলে তাঁকে পুনর্জন্ম নিতে হবে। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার
×