ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্ণাঢ্য আয়োজনে পৌষমেলা

রাজধানী শহরে গ্রামীণ জীবন, লোকায়ত সংস্কৃতির উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৩ জানুয়ারি ২০১৫

রাজধানী শহরে গ্রামীণ জীবন, লোকায়ত সংস্কৃতির উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়...। পৌষের ডাকে ছুটে এসেছিলেন সবাই। শীতের সকালে মুখর হয়ে উঠেছিল রমনার অশ্বত্থতলা। বিশাল বৃক্ষের নিচে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে গান নাচ কবিতা- কত কী! শিল্পীদের বর্ণাঢ্য পরিবেশনায় দারুণ মূর্ত হয়ে উঠেছিল পৌষ। পাশেই আবার পিঠেপুলির আয়োজন। সব মিলিয়ে বর্ণাঢ্য পৌষমেলা। উদযাপন পরিষদের ব্যানারে শুক্রবার এ মেলার আয়োজন করেছেন ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। গ্রামীণ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ আইল্যা জ্বালিয়ে তিন দিনব্যাপী মেলার উদ্বোধন করা হয়। বলা বাহুল্য, এই মেলা শুধু মেলা নয়। লোকজ সংস্কৃতির উৎসব। প্রতিবারের মতো এবারও পৌষমেলার শুরুটা ছিল কুয়াশায় ঢাকা। একটু দূরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল না। রাতে গাছের সবুজ পাতায় শিশিরের জল জমেছিল। সেখান থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ছিল মাটিতে। উফ, কী ঠা-া! এ অবস্থায় সূয্যিমামাই ছিল একমাত্র ভরসা। অথচ সে মামারও দেখা নেই। তবে হ্যাঁ, এই ছলে রাজধানী ঢাকার মানুষের পৌষের সকালটি দেখা হয়ে যায়। এই দেখাটাও জরুরী ছিল বৈকি! এর পর মূল অনুষ্ঠান। সূচনা করা হয় বাঁশির সুরে। হাসান আলীর মিষ্টি সুর ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলে চারপাশ। বাঁশির সুরের সঙ্গে যেন সুর মেলায় রমনার পাখিরা। গানে গানে প্রথম পৌষ বন্দনা করেন মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমির শিল্পীরা। তাঁদের গানে পৌষের প্রকৃতির রূপ বর্ণনা। মোমতাজ আলীর কথা ও সুরে শিল্পীরা গেয়ে যান- পৌষে বাও পাহাড়ী/মাঠে নতুন তরকারি।/শাক-সবজির সবুজ রঙে/মন রাঙিয়ে যায়...। একই সুরকারের গান নিয়ে মঞ্চে আসে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথ থেকে পৌষ বর্ণনা করেন লিলি ইসলাম। সুজিত মুস্তাফা গান নজরুল। দু’টো পরিবেশনাই ছিল প্রাসঙ্গিক। চমৎকার গেয়েছেন শিল্পীদ্বয়। বিমান চন্দ্র বিশ্বাস মঞ্চে এসেছিলেন ভাটি বাংলার সাধক পুরুষ জনপ্রিয় বাউল আবদুল করিমের গান নিয়ে। যেটুকু বাকি ছিল, করিমের গান যেন পূর্ণ করে দেয়। ভরিয়ে দেয়। লোককবির হাহাকারটুকু বুকে ধারণ করে বিমান কণ্ঠ ছাড়েন- কারে কি বলিব আমি/নিজে অপরাধী/কেঁদে কেঁদে চোখের জলে/বহাইলাম নদী রে বন্ধু/ছেড়ে যাইবা যদি...। এভাবে একক ও দলীয় সঙ্গীতে জমে ওঠে মেলা। তবে মঞ্চ যে বিশাল, নাচ ছাড়া ভরে না। উৎসবের রঙটুকু ছড়িয়ে দিতে মঞ্চে আসেন নৃত্যম, নৃত্যশ্রীসহ তিনটি সংগঠনের শিল্পী। লোকগানের সঙ্গে তাঁদের অদ্ভুত সুন্দর নাচ মুহূর্তেই বদলে দেয় পরিবেশ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মঞ্চের দিকে তাকান উপস্থিত দর্শক। একাধিক নৃত্যে উপস্থাপন করা হয় ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের চিরচেনা দৃশ্য। কিছুকাল আগেও গ্রামের ঘরে ঘরে সচল ছিল ঢেঁকি। শব্দ করে চলত ধান ভানার কাজ। এখন আর তেমন দেখা যায় না। গ্রামীণ ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই স্মারকটিও দেখা গেল মঞ্চে। ঢেঁকিতে পা দিয়ে চমৎকার ধান ভানল মেয়েরা। নাচে এই সংযোজন অনেককে লোকায়ত জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। একই রকম আয়োজন ছিল বিকেলে। এ পর্বে লোকসমাগম বেড়ে দ্বিগুণ হয়। জমে ওঠে পৌষমেলা। পৌষের আরেক বৈশিষ্ট- পিঠেপুলি। এ সময় গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হয় ভাপা, পাটিশসাপটা, সন্দেশ, দুধ চিতই, মুগ পুলি, ছিট পিঠা। মায়েরা মেয়েরা রাত জেগে পিঠার গায়ে অলঙ্করণ করেন। ফুল, লতাপাতা, পাখি, মাছের চোখ আঁকেন। এভাবে গোটা রাত পার হয়ে যায়। একদিকে চুলা থেকে পিঠা ওঠে। অন্যদিকে চলে গরম গরম খাওয়া। মায়ের হাতে তৈরি এসব পিঠার স্বাদ বরাবরই বেশি। আত্মীয়স্বজনদেরও নিমন্ত্রণ করে বাড়ি এনে পিঠা খাওয়ানো হয়। ঢাকার আজকের প্রজন্ম কি জানে এই সব পিঠেপুলির কথা? জানে না। জানলেও অল্পস্বল্প। আর তাই পৌষমেলায় রাখা হয়েছে পিঠেপুলির স্টল। বেশকিছু স্টলে পিঠা সাজানো। সকলের সামনেই চলছিল পিঠা বানানোর কাজ। গরম গরম পিঠা কিনে খাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বাসায় নিয়ে গেছেন। এসবের আগে, গ্রামীণ ঐতিহ্যের আইল্যা জ্বালিয়ে পৌষমেলা ১৪২১-এর উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ সময় আবৃতিশিল্পী রফিকুল ইসলামের কণ্ঠে ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রতীক্ষা’ কবিতাটি। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ ঘোষ। উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন পৌষমেলা উদযাপন পর্যদের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। পৌষকথনে অংশ নেন নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন মানজার চৌধুরী সুইট। পৌষমেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আবহমান কাল থেকেই বাংলার গ্রামীণ জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে আসছে পৌষ। এ সময় গোটা বাংলায় উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে। পৌষসংক্রান্তি ও পৌষমেলার আয়োজন করা হয়। কোথাও যাত্রাপালা, কোথাও বাউলগানের আসর বসে। পিঠাপুলিতে আপ্যায়ন হয়। কিন্তু আজকের প্রজন্ম এসবের তেমন কিছুই জানে না। তাদের কাছে শেকড়ের সংস্কৃতি তুলে ধরতেই রমনা বটমূলে পৌষমেলার আয়োজন করা হয়। পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিন দিনব্যাপী মেলা আগামীকাল রবিবার শেষ হবে।
×