ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখকদের লেখক

প্রকাশিত: ০২:৫০, ৪ জানুয়ারি ২০১৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখকদের লেখক

জন্ম : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭ তাঁকে বলা হয় আধুনিক বাংলা গল্পের অন্যতম শক্তিশালী কুশীলব। তাঁর গল্পে একের মধ্যে অনেক গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। গল্প, গল্পের চরিত্র নির্মাণ থেকে শুরু করে বিষয় নির্বাচনেও তাঁর তুলনা একমাত্র তিনি। বাংলা সাহিত্যে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যাত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন কম কিন্তু তাঁর লেখার ব্যপ্তি আর গভীরতা এতই বেশি যে তা সবাইকে বিস্মিত করে। মূলত গল্পকার এটাই তার বড় পরিচয়। ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলায়। বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাঠ শেষ করেন। পড়াশোনা শেষে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশভাগ পরবর্তী বাংলা গল্পে যে ক’জন উল্লেখযোগ্য লেখক আছেন তাদের মধ্যে ইলিয়াসের ঘরানা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার গল্পে পুরান ঢাকা মূর্ত হয়ে উঠে। ১৯৭৩ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সুরাইয়া তুতুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং গোপনে তাঁদের সহায়তা করে অনন্য দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লেখা দুধভাতে উৎপাত, দোযখের ওম গল্পগ্রন্থে প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল-এ উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। তাঁর লেখায় ছিল গভীর জীবনবোধ, তীক্ষè পর্যবেক্ষণ শক্তি ও ক্ষুরধার লেখনী শক্তি। ক্ষুধায় কাতর রুগ্ন মানুষের জীবনালেখ্য তাঁর সাহিত্যকর্মে তুলে ধরে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ধনী-গরিবের ব্যবধান, ভেদাভেদ। এছাড়া প্রবন্ধের বই সংস্কৃতির ভাঙাসেতু নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখায় জীবনমুখী আবেদন, চরিত্র সৃষ্টিতে মুন্সিয়ানা ও আঞ্চলিক সংলাপের যথার্থ প্রয়োগ উঠে এসেছে সুনিপুণভাবে। চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা দুটি উপন্যাসে তিনি প্রমাণ করেছেন বেশি না লিখলেও চলে। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য পাতায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শুধু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যেই নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই একজন অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক। তিনি কখনই লেখার সংখ্যা বৃদ্ধিতে মনোযোগী ছিলেন না। ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রকরণে মনোযোগী এ লেখক তাই খুব বেশি লেখেননি জীবনে। কিন্তু যা লিখেছেন শিল্প-বিচারে তা এখনও বিশ্বমানের, এমনটিই মনে করেন সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচকরা। তাঁর সাহিত্য জীবন ২টি উপন্যাস, ৫টি গল্পগ্রন্থ ও ১টি প্রবন্ধ সঙ্কলন ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার সঙ্কলনে সীমাবদ্ধ থাকলেও দেশের সাহিত্যভা-ারে তাঁকে বিশেষভাবে গণ্য করা হয়। সমালোচকরা তাঁকে লেখকদের লেখক বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তাঁর রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। কথা সাহিত্যে সার্বিক আবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালে পান একুশে পদক।
×