ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ছে না, কমিশন গঠনের পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৪ জানুয়ারি ২০১৫

কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ছে না, কমিশন গঠনের পরামর্শ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করছে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, বিনিয়োগ না বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ গ্যাস, বিদ্যুত ও জমির স্বল্পতাসহ অবকাঠামো সঙ্কট। এডিপি বাস্তবায়ন ও গুণগত মান কাক্সিক্ষত নয় উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, দেশের ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে নাজুক পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগের খরা কাটছে না। তবে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উপায় এই বিনিয়োগ বাড়াতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। একই সঙ্গে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সমঝোতামূলক রাজনীতি ও আর্থিক খাতে একটি কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারী এই গবেষণা সংস্থাটি। শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৪-১৫ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষকরা এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক অর্থনীতিতে চারটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান। প্রতিবেদনে নির্বাচনের পরও ব্যক্তি বিনিয়োগে মন্দা, আর্থিক খাতের নাজুক পরিস্থিতি, পোশাক খাতের রফতানি পরিস্থিতি ও জনশক্তি রফতানির পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ঘরে আটকে গেছে। যদিও এ হার কম নয়, তবে বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের জন্য সুপার বাংলা গ্রোথ রেট অর্থাৎ ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও তার উৎকর্ষ (উৎপাদনশীলতা) বাড়াতে হবে। আরও তিন বছর থেকেই আমরা বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছি। সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, তিনটি কারণে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাড়ছে না। প্রথমত, বিনিয়োগ না বাড়ার প্রচলিত কারণ হলো গ্যাস, বিদ্যুত, জমির অভাব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির সমস্যা। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের শ্লথগতিও বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ও এডিপির গুণগত মান কাক্সিক্ষত নয়। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সরকারের ব্যয় করার প্রবণতা অনেক কম। এ ছাড়াও নানা ধরনের সংস্কারমূলক দুর্বলতা আমাদের রয়েছে। এসব দূর করতে সংস্কারমূলক কাজ শুরু হলেও তার গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগ না বাড়ার তৃতীয় কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনের পর সাধারণত সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে যেন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে ভরসা পায়। তাছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশায় উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। কিন্তু এবার নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না। এতে বিনিয়োগও বাড়ছে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, একদিকে দেশে বিনিয়োগ নেই। অন্যদিকে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে দেশ থেকে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। তাঁর মতে, এই পাচারের পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অর্থ পাচার হচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বলে এই পাচারের অর্থই আবার দেশে ফিরিয়ে আনছেন অনেকে। তাই এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়ানো দরকর। অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি নতুন এক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে শিল্প ঋণের যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, তা বেশিরভাগই লোন ট্রাস্ট রিসিপ (এলটিআর) বা বিশ্বাসী ঋণের। আবার খেলাপী ঋণের তথ্যেও সন্দেহের জায়গা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, বেনামি ঋণও পুনর্তফসিল করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশে আটকে আছে বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ অবস্থায় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ যদি না বাড়ে, তাহলে প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে সংখ্যক লোক প্রবেশ করছে, তাদের জন্য সমস্যা হয়ে যাবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। খাদ্য আমদানি-রফতানির বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা খাদ্য আমদানি ও রফতানির বিপক্ষে নই। বরং এর মাধ্যমে দেশের খাদ্যদ্রব্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। তবে খাদ্য রফতানি করতে গিয়ে বাংলাদেশ যেন সঙ্কটে না পড়ে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, চাল রফতানি করতে হলে দেশের জন্য ১৫ লাখ টন মজুত রাখতে হবে। এর ওপর মজুত থাকলে রফতানি করা যেতে পারে। এ ছাড়া কৃষি খাতে যে ভর্তুকি দেয়া হয় তা বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণার্থে দেয়া হয়। এ ভর্তুকির সুফল বিদেশীরা পেয়ে যাচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৫ অর্থবছরে কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে জিডিপিতে বিনিয়োগের অবদান সাড়ে ৩২ শতাংশ করা প্রয়োজন। অথচ আমরা এর কাছাকাছিও যেতে পারিনি। বর্তমানে এ হার সাড়ে ২৬ শতাংশ। বিনিয়োগের অবদান বাড়াতে বিনিয়োগের পরিমাণ ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচক বিশ্লেষণ করে ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৪ সালে রফতানি প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় গতিশীল হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হয়েছে, বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা দেখা গেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য পরিস্থিতির নিম্নগতিতে ভর্তুকির চাপ কমেছে। তবে অর্থনীতিতে সম্প্রতি যে চ্যালেঞ্জ দেখা গেছে তা হলো- বেসরকারী বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি অনেক বেশি, এডিপির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে, ব্যাংকিং খাতে অধিক তারল্য ও ক্যু ঋণ বেড়েছে এবং প্রবাসী আয় তুলনামূলক কমে গেছে। মূল্যস্ফীতির হার স্বস্তিজনক পর্যায়ে থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেনি। অথচ দেশে খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণত নির্বাচনের পর ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়লেও এবার তা হয়নি। এটা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ছিল না। সম্প্রতি টার্ম লোন বাড়লেও এটা দিয়ে শিল্প ঋণ বেড়েছে বলে বিবেচনা করা যাবে না। তাছাড়া মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ বাড়লেও এসব যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিকে শিল্পের মূলধন যোগানের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার দক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ব্যাংকিং খাতে অধিক তারল্য থাকলেও উচ্চ সুদ হার রয়ে গেছে। বিদ্যুত উৎপাদন বাড়লেও শিল্প খাতে বিদ্যুত যাওয়ার হার কম। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতিও একই। তাছাড়া অবকাঠামোগত দুর্বলতা একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ভারতে রেমিটেন্স আউটফ্লো হচ্ছে। প্রবাসী আয় বাড়ানোর পাশাপাশি রেমিটেন্স আউটফ্লো কিভাবে কমানো যায় সে বিষয়েও সরকারের নজর থাকা প্রয়োজন। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, নির্বাহী গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খানসহ সংস্থাটির গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
×