ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৭ জানুয়ারি ২০১৫

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

(৬ জানুয়ারির পর) এমনকি সরকারও পারবে না। সেনা প্রহরায় শান্তি থাকে বহুদূর, তাতো সবাই দেখেছি। চতুর্থত, তাহলে বাঙালীরা কি পাহাড়ে পাহাড়ীদের পাশে শান্তিতে থাকতে চায় না? অধিকাংশ মানুষের মত অধিকাংশ বাঙালী পাহাড়ীদের পাশে শান্তিতে বাস করতে চায়। তাহলে কেন এই সংঘর্ষ, হামলা, আগুন দিয়ে ঘর-শস্য পোড়ানো, আনারস ও সেগুন গাছের বাগান কেটে ছারখার করা হয়? কারা করে? কেন করে? সর্বশেষ, নানিয়ারচরের ঘটনাটি চোখ খুলে দেয়ার মতো একটি ঘটনা। ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে ওই এলাকায় কেউ একটি গুজব ছড়িয়ে দেয় যে কালকে হরতাল আসছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন ভোরে দেখা গেল বাঙালীদের ৯ একর আনারস- সেগুন বাগানের সব ফলন্ত গাছ ও সেগুন চারা টুকরো টুকরো করে কাটা! ১৬ ডিসেম্বর রাতে পাহাড়ীদের ৩টি গ্রামের নানা মতানুসারে ৩৫ থেকে ৬০টি ঘর ও দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দোকানের ক্যাশ লুট, মালামাল লুট, দোকানসহ বাড়িঘরের ধানসহ সব কিছু পুড়ে গেছে বলে মালিক পাহাড়ীরা জানায়। এই এলাকাটি ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণাধীন। পাহাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা যখন তাদের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিচ্ছিল, তখন স্থানীয় পাহাড়ী এক নেতা চাকমা ভাষায় ওদেরকে বলছিল- ‘এত মিথ্যা কথা বলছিস কেন, এত বাড়িয়ে বলছিস কেন’ (আমি চট্টগ্রামের মেয়ে বলে চাকমা ভাষার কিছু কিছু বুঝতে পারছিলাম)। ওরা যে অনেক বাড়িয়ে বলছিল, সেটা মাঠ গবেষক হিসেবে এমনিতেই আমি বুঝেছিলাম, মনে হচ্ছিল অন্তত! ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা দুটো পরিকল্পিত যদিও এর পরিণতিতে দরিদ্র বাঙালী ও পাহাড়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা সবসময় ঘটে থাকে। কথা হচ্ছে, কে বা কারা এ হানাহানির পরিকল্পনার সুবিধাভোগী এবং পরিকল্পক? এ কথা বলা বাহুল্য যে, বাঙালী পাহাড়ীর সংঘর্ষ জিইয়ে রাখা হলে তৃতীয় পক্ষের লাভ হয়। সেটি বোঝা কষ্টকর নয়। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিটিকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে সে সময়ের বিরোধী দলের উস্কানি ও সহায়তায় ’৯৮ সালের দিকে শান্তিচুক্তিবিরোধী একটি গোষ্ঠী চাকমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে জন্ম হয় ইউপিডিএফ নামের গোষ্ঠীটির। এরা নিয়মিত সন্ত্রাস পরিচালনা করছিল সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে। সবাই অবগত আছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী বসতি বিস্তারে এবং পাহাড়ীদের মধ্যে ভীতি, ত্রাস সঞ্চার করে অনেক ক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে পাহাড়ীদের বসতি জ্বালিয়ে দেয়া, হত্যা, ধর্ষণের মাধ্যমে চরম নির্যাতন করেছিল সে সময়ের সেনা সদস্যরা। সে সময়ের আঞ্চলিক সেনাপ্রধান কর্মকর্তাকে বিদেশী সংবাদপত্রে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের হত্যাকারী’ হিসেবে ছবিসহ প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছিল! এই নির্যাতনের বহু কাহিনী দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি বলে বাঙালী জনগণ এ বিষয়ে ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে। এ সময়টিকে পার্বত্য অঞ্চলের সেনাশাসন বলা হয়। এ সময়ের একটি কুখ্যাত কলঙ্কজনক উদাহরণ- হিল্ উইমেনস্ ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার সেনাসদস্য কর্তৃক অপহরণ ও গুম হওয়ার ঘটনা। যেটি সম্ভবত প্রথম বাঙালী শিক্ষিত সমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত ও শোকার্ত করেছিল! শাস্তিচুক্তির পরও হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। কারা করেছে সেটি অনুসন্ধান জরুরী। (৪) একই সঙ্গে আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। ঘন অরণ্যবেষ্টিত পার্বত্য অঞ্চলে একদিকে ভারতীয় অপরদিকে দেশীয় বাঙালী মৌলবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জামায়াত কর্তৃক জন্ম দেয়া জেএমবি, রোহিঙ্গা, অন্য মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা থেকে এ অঞ্চলের সাধারণ পাহাড়ী বাঙালীর শান্তিপূর্ণ জীবনের নিরাপত্তাকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে হবে। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা, বিডিআর ও পুলিশের একটি ভূমিকা থাকবে- তা বলা বাহুল্য। তবে স্মরণ রাখতে হবে অতীতে পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠী তাদের ওপরে নির্মম সেনা নির্যাতনের ফলে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল! সুতরাং সেনা, পুলিশের প্রথম দায়িত্ব হবে- পাহাড়ীদের সুরক্ষা প্রদান করে তাদের মনে আস্থা স্থাপন করা। মনে হয়েছে সেনাসহ নিরাপত্তা বাহিনী পাহাড়ীদের মনে সে আস্থা এখনও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। এ লক্ষ্যে তাদের অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে কাজ করতে হবে, সন্দেহ নেই তাদের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে যেগুলো তাঁরা নিজেরা নিজেদের করবেন- (ক) তিন পার্বত্য জেলায় ৬টি সেনানিবাস করার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এর বাইরে ছোট ছোট পাহাড়গুলোতে সেনা ক্যাম্প থাকবে না। এ সিদ্ধান্ত পাহাড়ী-বাঙালী-সরকার গ্রহণ করেছে। এখন পাহাড়ীরা বাঙালীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা বিশ্বাস করে যে সেনা-পুলিশ বাঙালীদের প্রশ্রয় দেয়, তাদের অপরাধকর্মে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। ওদিকে বাঙালীরা অভিযোগ করেছে তাদের একটি সীমানা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে অপারগ। যাই হোক, পার্বত্য অঞ্চলে সেনানিবাসের জন্য, বিডিআর বাহিনীর জন্য যে বিশাল পরিমাণ জমি দখলে নেয়া হয়েছেÑ সে বিষয়ে আমাদের অসন্তোষ আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করিÑ ছোট আয়তনের এই দেশে সেনানিবাসের নামে বা বিডিআরের জন্য এত বিশাল জমির প্রয়োজন নেই। তাছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশে, পাশের দেশ ভারতেও শহরের মধ্যস্থলে বা জনবসতির কাছাকাছি কোন সেনানিবাস দেখা যায় না। সেনানিবাস জনগণের বসতি থেকে বহু দূরে রাখা হয়Ñ এটিই আন্তর্জাতিক রীতি। রাঙ্গামাটির যে সেনানিবাসের দীর্ঘ দেয়াল দেখা গেল, পাহাড় কেটে অতবড় সেনানিবাস, উপরন্তু ব্রিটিশ শাসকদের চাপিয়ে দেয়া গল্ফ খেলার জন্য বিশাল জমি অধিগ্রহণ দেখে সত্যিই স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাদের দেশপ্রেমজনিত চরিত্রের খামতি দেখে চরম হতাশ হলাম। অন্তত গল্ফ খেলার জমিটি ছেড়ে দেয়া দরকারÑ এটি দাসত্বেরও পরিচায়ক। ক্ষুদ্র আয়তনের দেশের মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনী দৃষ্টিকটূভাবে এত বিশাল জমি নিলে সেনাদের সঙ্গে ভূমিদস্যুদের তফাত থাকবে কি? পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চিত ও শোষিত পাহাড়ী এবং রাজনীতির শিকার বাঙালীদের শান্তি রক্ষার কাছে সুনাম অর্জন করেছেন পাহাড়ে সেই ভালবাসার নিদর্শন প্রদর্শন করুন এবং সম্মান, আস্থা অর্জন করুন এবং শান্তি নিশ্চিত করুন। (৩য় পর্ব আগামী সোমবার)
×