ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্লজ্জ মিথ্যাচার

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

নির্লজ্জ মিথ্যাচার

তৌহিদুর রহমান ॥ সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন নির্লজ্জ মিথ্যাচার শুরু করেছে। তবে তাদের সেই মিথ্যাচারের কূটনীতি ফাঁস হয়ে গেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সভাপতি অমিত শাহ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে কোন ফোনই করেননি। বরং নয়াদিল্লীর বিজেপি অফিসে বেগম খালেদা জিয়ার অফিস থেকে দু’দফা ফোন করলেও কেউ তা রিসিভ করেননি। এদিকে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের নামে ভুয়া বিবৃতি প্রকাশ করার ঘটনাও ধরা পড়ে গেছে। বিএনপি ওই মিথ্যা বিবৃতি প্রকাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম ভাঙ্গিয়ে মিথ্যাচারের এ রাজনীতি খোদ বিএনপি সমর্থকদেরও লজ্জায় ফেলেছে। সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে বিএনপির পক্ষ থেকে অবরোধ কর্মসূচী দেয়া হয়। এই অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে বুধবার রাত সাড়ে দশটায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ফোন করেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সে সময় জানিয়েছিলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতের বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ টেলিফোন করেছেন এবং অমিত শাহ টেলিফোনে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়। সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহ। বুধবার রাতে তিনি ফোনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁর আশু সুস্থতা কামনা করেন। এমন সৌজন্য দেখানোর জন্য খালেদা জিয়া এই শীর্ষ বিজেপি নেতাকে ধন্যবাদ জানান। এছাড়া দেশে-বিদেশের অনেকেই খালেদা জিয়াকে ফোন করে তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ফোন করে অসুস্থতার খোঁজখবর নিয়েছেন বলে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তার পুরোটাই মিথ্যা ও বানোয়াট। খালেদা জিয়াকে বিজেপি সভাপতি কোন টেলিফোন করেননি। উল্টো বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে অমিত শাহর কার্যালয়ে দুই দফা ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তবে বিএনপির সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এদিকে অপর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টিতে ভারতীয় হাইকমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হাইকমিশনের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, খবরটি মিথ্যা। বিজেপি সভাপতি খালেদা জিয়াকে ফোনও করেননি, কথাও বলেননি। ভারতীয় হাইকমিশনের দায়িত্বশীল সূত্রটি আরও জানায়, হাইকমিশনে তথ্য রয়েছে, বুধবার রাতে খবরটি প্রচারিত হওয়ার পর শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে অমিত শাহকে ফোন করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি টেলিফোনের বিষয়টি জানতে চাইলে অমিত শাহ তাঁকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে দু’দফা তাঁর দফতরে ফোন গিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোন কথা হয়নি। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাদের কাছেও সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দলটিকে নিয়ে মিথ্যাচার যে করছেন তা অনভিপ্রেত। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দা জানিয়েছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যানের নামে মিথ্যা বিবৃতি প্রচার করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দুই কংগ্রেস সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস ও কমিটির সদস্য এলিয়ট এ্যাঙ্গেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, কোন পক্ষের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নামে ভুয়া বিবৃতি ব্যবহার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দুটি অনলাইন সংবাদ পোর্টালে বৃহস্পতিবার রাতে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের নামে ওই বিবৃতির খবর প্রকাশ করে। এড রয়েস ও এলিয়ট এ্যাঙ্গেলসহ ছয় কংগ্রেস সদস্যের নাম উল্লেখ করে এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া রয়েস ও এ্যাঙ্গেল ছাড়াও রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য স্টিভ শ্যাবট, জর্জ হোল্ডিং ও ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য জোসেফ ক্রাউলি ও গ্রেস মেং ওই বিবৃতিতে সই করেছেন বলে দাবি করা হয়। আবার কয়েকটি গণমাধ্যমে কংগ্রেসম্যানদের সই করা বিবৃতির স্ক্যান কপিও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু শুক্রবার কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য গ্রেস মেংয়ের কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, এ ধরনের কোন বিবৃতির বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েসের কার্যালয় থেকেও ওই বিবৃতির খবরে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। পরে রয়েস ও এ্যাঙ্গেলের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ছয় কংগ্রেস সদস্যের নামে ৭ জানুয়ারির যে বিবৃতির বরাত দিয়ে বাংলাদেশের কিছু সংবাদ মাধ্যমে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা ‘বানোয়াট’। এতে আরও বলা হয়, পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি ও কংগ্রেস সদস্যদের অনেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এলেও কমিটি বা কোন সদস্য এ ধরনের কোন বিবৃতি দেননি। এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিশেষ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বৈদেশিক দূত পরিচয় দিয়ে জাহিদ এফ সরদার সাদী নামের এক ব্যক্তি গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। কংগ্রেস সদস্য হাকিম জেফরি বিষয়টি হাউসে উত্থাপন করেন। এ বিষয়টিও সত্য নয় বলে কংগ্রেস সদস্য হাকিম জেফরির কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে। জাহিদ এফ সরদার সাদীর ফেসবুক পাতায় কংগ্রেসের একটি বিশেষ বিবৃতি এবং উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের কথাও লেখা হয়েছে, যদিও তার কোন সত্যতা মেলেনি। জানা গেছে, জাহিদ এফ সরদার সাদী যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বসবাস করেন। ফ্লোরিডা ও এ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে দুই ডজনের বেশি প্রতারণার মামলায় বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে সাজাও খেটেছেন তিনি। এ্যারিজোনায় ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণার একটি মামলার নথিতে দেখা যায়, সাদী কখনও সর্দার জাহিদ ফারুক, কখনও সর্দার ফারুক, এস ফারুক, সর্দার ফারুক আবার কখনও ফারুক সর্দার নাম নিয়ে প্রতারণা চালিয়ে এসেছেন। ২০১৩ সালের ১৭ নবেম্বর তাঁকে বিএনপির বৈদেশিক দূত এবং বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সরদার সাদীকে নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে। কারণ এ রকম একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলের বৈদেশিক দূত নিয়োগ দেয়ায় দুই সপ্তাহ আগেই নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্ময় প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ সম্রাট। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির আরেক নেতা মোঃ বশির জানিয়েছেন, এই ব্যক্তি কংগ্রেসম্যানদের সই জাল করে ভুয়া বিবৃতি প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইমেজ ভূলুণ্ঠিত করেছে। এদিকে এত কিছুর পরেও বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সরাসরি টেলিফোন করে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন। শুক্রবার ভারতের হাইকমিশন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফোন করার খবরটি ভুয়া বলে এ সংক্রান্ত যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তাও অস্বীকার করেছে দলটি। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিজেপি প্রধান সরাসরি টেলিফোন আলাপে খালেদা জিয়ার কুশলাদি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। দুই প্রতিবেশী দেশের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রধানের আলাপ একটি প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক ঘটনা বলেও বিবৃতিতে বলা হয়।
×