ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃষক ও কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা বিপাকে পরিবহন সঙ্কটে

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৫

কৃষক ও কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা বিপাকে পরিবহন সঙ্কটে

এম শাহজাহান ॥ প্রতিদিনের আয় উপার্জনের ওপর সংসার চলে ভ্যানচালক জব্বার আলীর। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পয়সা দিয়ে রাতে চাল, ডাল, সবজি কিনে বাসায় ফেরেন তিনি। ভোগ্যপণ্যের দাম কম থাকায় গত এক বছর বেশ ভাল কেটেছে জব্বার আলীর। পণ্যমূল্য কম থাকায় এই সময়ে কিছু পয়সা সঞ্চয় হয়েছে তার। তবে বিএনপি-জামায়াত শিবিরের গত ২০১৩ সালের হরতাল-অবরোধ ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা না ভুলতেই আবার শুরু হয়েছে সেই তা-ব। পণ্যবাহী ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম। ভরা মৌসুমে কৃষকের ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে সবজি। পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কেনাবেচা কমে গেছে। অথচ হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার আগে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে আসছিল। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ছিলেন স্বস্তিতে। এখন আবার সব কিছুর দাম উর্ধমুখী। ক্ষেতে সবজি নষ্ট হওয়ায় কৃষক পড়েছেন বিপাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে অর্থনীতিতে নতুন সঙ্কট তৈরি হওয়া। এই সঙ্কট এখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। জানা গেছে, বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ থাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি পণ্য পরিবহনে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে শীতের সবজির ভরা মৌসুমে সেগুলো মাঠে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সবজি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা চরম আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচা মালের আড়ত ঢাকার কাওরান বাজারে সাধারণত মধ্য রাতের কিছু আগে থেকে ট্রাকে করে সবজি আসতে শুরু করে। গড়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক এখানে সারাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসে। কিন্তু অবরোধের কারণে পণ্যবাহী ট্রাক আসার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, অবরোধকারীরা ট্রাক জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কখনও ভাংচুর করে পণ্যসহ গাড়ি নষ্ট করে দিচ্ছে। এতে করে ঝুঁকি নিয়ে কেউ আর আসতে চাচ্ছে না। আর আসলেও ভাড়া দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে কাওরান বাজারের সবজির পাইকারি বিক্রেতা মোঃ জসিম উদ্দীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অবরোধের কারণে বেপারিরাও সেভাবে আসছে না। ফলে বাজারে পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা কমে গেছে। পিকেটাররা পণ্যবাহী ট্রাক জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এতে করে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বেপারিরা লোকসানে পড়ছেন। এদিকে ট্রাক চালকরা বলছেন তারা আছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে। গফুর নামে শেরপুরের এক ট্রাক চালক বলেন, মালিককে অনেক বুঝিয়ে ট্রাক নামাতে হয়। পেটের টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় নামতে হচ্ছে তাদের। পণ্যবাহী ট্রাক রাস্তায় জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে অনেকে গাড়ি বের করছেন না। ফলে ট্রাক ভাড়া বেড়ে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে সবজি নিয়ে কাওরান বাজারে এসেছেন ট্রাক ড্রাইভার জাভেদ মিয়া। তিনি বলেন, এক ট্রাক সবজি আনতে স্বাভাবিক সময় ভাড়া লাগে ১২-১৩ হাজার টাকা। কিন্তু অবরোধের কারণে দিতে হচ্ছে ১৬-২০ হাজার টাকা। তারপরও চালকরা ঝুঁকি নিয়ে আসতে চান না। এরকম চললে তো আমাদের মাল আনা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। ঝিনাইদহ থেকে ফুলকপি নিয়ে যাত্রাবাড়ী বাজারে এসেছেন খালেক মিয়া। তিনি বলেন, আমার ফুলকফি কেনা আরও দুদিন আগে। গাড়ি না পাওয়ায় সময়মতো আনতে পারিনি। অনেক ফুলকপি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন চালান উঠানোই দায় হয়ে পড়ছে। কাপ্তান বাজারের খুচরা বিক্রেতা খলিল জানালেন, আড়তে সবজির সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণে শীতকালীন ভরা মৌসুমে শীতের সবজির দাম বেড়ে গেছে। হরতালের আগে প্রতিদিন সবজির দাম কমে আসলেও এখন আবার তা বাড়তির দিকে রয়েছে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত ॥ গত কয়েক বছর ধরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। চাল উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে সবজি উৎপাদন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন শাক-সবজি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এজন্য সরকারকে কৃষি ভর্তুকি বাড়ানোসহ কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে কৃষি উৎপাদন বাড়ায় ভোগ্যপণ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। পণ্যের দাম কমে এসেছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের কারণে গত ২০২৩ সালে কৃষিখাত বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সেই সঙ্কট কাটিয়ে না উঠতেই আবার শুরু হয়েছে অবরোধ। এর ফলে সারাদেশের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে টানা অবরোধ আর হরতালে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলার সবজি চাষী ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নরসিংদী এলাকার কৃষকরা সবচেয়ে চাপের মুখে রয়েছেন। এদিকে পরিবহন বন্ধ থাকায় সবজির পাইকারি বাজারে কেনাবেচা স্থবির। মোকামেই পচছে পাইকারদের কেনা সবজি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করতে না পারায় গত এক সপ্তাহে শিম, কপি, বেগুন, পটল, মুলাসহ প্রায় সব ধরনের সবজি অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না কৃষক। সবজি চাষে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জেলার চাষীরা। অনেক চাষী ক্ষেত থেকে সবজি বাজারে আনছেন না। চলমান হরতাল-অবরোধে ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। চাষীদের এখন দুরবস্থা চলছে। টানা হরতাল ও অবরোধে পরিবহন সঙ্কট থাকায় আড়ত থেকে সবজি বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে পারছেন না পাইকাররা। এজন্য আড়তেই পচছে সব সবজি। অবরোধে ব্যাহত রফতানি কার্যক্রম ॥ বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পের আয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে পোশাক রফতানি খাতে আয় ছিল ১২ বিলিয়ন মাকিন ডলার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখন প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হচ্ছে। এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে পোশাক শিল্পে বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে দুইবার। পাশাপাশি এ শিল্পের শ্রমিকদের জন্য একটি স্থায়ী মজুরি বোর্ড গঠন করে দিয়েছে সরকার।
×