ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

আজ ১০ জানুয়ারি। বাঙালীর জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে আসেন এ দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে দেশের মানুষের মননে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুনেছিলেন, সেই দেশের রক্তভেজা মাটিতে তাঁর ফিরে আসার দিন আজ। কেমন ছিল সেই দিনটি? মহামানবের আগমনের দিনটি আগে থেকেই জানা ছিল দেশের মানুষের। তাই সকাল থেকেই অপেক্ষা, কখন ফিরবেন বাঙালীর প্রাণের পুরুষ। বাঙালীর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সোমবারের আবেগ ও আনন্দ আজকের দিনে বুঝিয়ে বলা কঠিন। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অন্যদিকে মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন। নতুন করে দেশ গড়া ও নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে দেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল যে মহামানবের দিকে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তিনি পা রাখেন তাঁর প্রাণের মাটিতে। মাটির সন্তান ফিরলেন স্বপ্ন ভূমিতে। দু’চোখে কী স্বপ্ন খেলা করছিল তাঁর? স্বপ্ন ছিল তাঁর একটি স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন ছিল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের। স্বপ্ন ছিল এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। সেই স্বপ্ন নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে পা রাখা মানুষটি কি ভাবতে পেরেছিলেন, নয়টি মাসের যুদ্ধে কী তা-ব চালিয়ে গেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা? ভাবতে পারেননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মানুষের তখন খাদ্যের নিরাপত্তা নেই। অনেকেরই আশ্রয় নেই। কিন্তু বিশ্বাস ছিল অটুট। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, তিনি ফিরলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে এই দেশ। তাঁর জাদুকরি সাংগঠনিক শক্তিতে তিনি আবার নতুন করে এই দেশটিকে গড়ে নিতে পারবেন। পারবেন সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। সেই স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়েই সেদিন মানুষ উপস্থিত হয়েছিল ঢাকার বিমানবন্দরে। বিমানটি বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করার মুহূর্তে উচ্চারিত হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সেই স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলার মানুষ জেনেছিল, তারা আর অভিভাবকহীন নয়। তাদের অভিভাবক এসেছেন। মুক্ত মানুষ হিসেবে তিনি বাংলার মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে তাদের মাঝেই ফিরে এসেছেন। প্রিয় নেতাকে দেখতে কত মানুষ সেদিন একত্রিত হয়েছিল ঢাকায়? সংখ্যা গুণে হিসাব করা যাবে না। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্সের ময়দানে পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগেছিল পাঁচ ঘণ্টা। ঘরে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী। প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে অপেক্ষায় বাবা ও মা। কিন্তু তিনি নিজের বাড়িতে না গিয়ে কেন গেলেন রেসকোর্সে? উত্তর খুবই সহজ। যে মানুষটির স্বপ্ন জুড়ে কেবলই দেশের মানুষ, তিনি মানুষের কাছেই সবার আগে পৌঁছে যেতে চান। তাঁর কাছে দেশের মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না কোনদিন। তাই দেশের মাটিতে পা রেখে তিনি প্রথম তাঁর প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যই পেতে চেয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্টেটসম্যানশিপ কাকে বলে! রেসকোর্সে সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। প্রাণের আবেগমাখা সেই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ মানবদরদী এক মহান নেতার কী দূরদর্শিতা। ঐ ভাষণে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম, দুর্গ গড়ে তোল। আজ আবার বলছি, আপনারা একতা বজায় রাখুন।’ তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব। বাংলাদেশ আজ মুক্ত-স্বাধীন। একজন বাঙালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ রূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন শক্তি কারও নেই।’ সবাইকে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালীরা কেবল স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।’ স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন শান্তির এক বাংলাদেশের কথা। অর্থাৎ আবারও সেই শান্তির স্বপ্ন মানুষের মনে ছড়িয়ে দেয়া। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন যান। লন্ডনে একদিন ব্যস্ত সময় কাটানোর পর তিনি ১০ জানুয়ারি দিল্লী হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু ৮ তারিখেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে দেখা করতে গেলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এই নিয়ে ব্রিটেনে খুব সমালোচনা হয়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কোন পদে অধিষ্ঠিত হননি। ঐ সময় তিনি ছিলেন শুধু রাজনৈতিক দলের প্রধান। সব প্রটোকল ভেঙ্গে ১০ জানুয়ারির শীতের সকালে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করতে গিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেখানেও তাঁকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মান দিয়ে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় রেখেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কখন ফেরত আনা হবে। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু যখন চাইবেন তখনই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শেষ সেনা সদস্যকে ফিরিয়ে আনা হবে। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর শেষ সেনা সদস্য দল প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক, সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ধর্মীয় মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই বিচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন তিনি। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও তাঁর স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিনযাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বাবার মতই তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধির দিকে। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা সবাই তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ নেব। সাম্যের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করব। জয় বাংলা। লেখক: অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক [email protected]
×