ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টক নয় শুধু মিষ্টি তেঁতুল, গাছ বাঁচে তিন শ’ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫

টক নয় শুধু মিষ্টি তেঁতুল, গাছ বাঁচে তিন শ’ বছর

মোরসালিন মিজান ॥ তেঁতুলের স্বাদটা এক কথায় অদ্ভুত! মুখে পুরলেই হলো। চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে যায়। চোখবুজে আসে। কাঁচা তেঁতুলের এক স্বাদ। পাকাটির অন্য। তবে দুটোই টক। ভীষণ টক। হ্যাঁ, মেয়েরা তেঁতুল বেশি পছন্দ করে। স্বাদটা নিতে জানেন তাঁরা। আর যাঁরা টক এড়িয়ে চলেন সব সময়, তাঁদের জন্য রয়েছে মিষ্টি তেঁতুল! ভেষজ গুণাগুণের কারণেও তেঁতুলের আলাদা কদর আছে। তেঁতুলের ইতিহাসটি ঘেঁটে দেখা যায়, খ্রিস্ট জন্মের ৪শ’ বছর আগে মিসর ও গ্রিক সভ্যতার অধিবাসীরা একে ফল হিসেবে গ্রহণ করেন। এর আদি নিবাস আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল ও দক্ষিণ এশিয়া। প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষ ও সুদানের জঙ্গলে তেঁতুল হয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, সুদান থেকেই এটি বাংলাদেশে আসে। সারাদেশেই দেখা যায় তেঁতুল গাছ। অনেকেই জানেন না, এ গাছ বহু দিন বাঁচে। এমনকি তিন শ’ বছর পর্যন্ত! বীজের গাছ থেকে ফল ধরতে প্রয়োজন হয় ১০ থেকে ১২ বছর। গাছ ২৪ মিটার পর্যন্ত উপরে বাড়ে। এখন তেঁতুলের মৌসুম। এই শীতের কালে তেঁতুল গাছের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে থোকা থোকা ফল। রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ভবনের সামনে আছে একাধিক তেঁতুল গাছ। রবিবার সেখানে দেখা যায়, ঘন পাতার আড়ালে থোকা থোকা তেঁতুল ধরে আছে। যেন কিছুটা লুকিয়ে আছে। এক কর্মকর্তার তেঁতুল নিয়ে বেশ আগ্রজ। তিনি জানান, প্রতিবছর কয়েক বস্তা তেঁতুল সংগ্রহ করেন তাঁরা। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, বাঁকানো এই ফল ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বহিরাংশ প্রথমে সবুজ, ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করে। পাকা অবস্থায় খোসা মচমচে ধরনের হয়। এর ভেতরে থাকে পুরু শাঁস। পাকা ফলের শাঁস শুকিয়ে খাওয়া যায়। প্রতিটি ফলের ভেতরে ৫ থেকে ১২টি বীজ থাকে। বীজের রং উজ্জ্বল খয়েরি। দেশী জাতের তেঁতুলের মধ্যে কোনটির ফল সরু ও লম্বা, কোনটি মোটা ও গোলগাল। তবে আলাদা করে বলতে হয় মিষ্টি তেঁতুলের কথা। কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় জানান, থাইল্যান্ডে একাধিক জাতের মিষ্টি তেঁতুল হয়। সেখান থেকে এসেছে বাংলাদেশে। মাত্র চার বছরের মধ্যে ফলন হয়। ঢাকার নার্সারিগুলোতে মিষ্টি তেঁতুলের গাছ কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। মিষ্টি স্বাদের পাশপাশি কুষ্টিয়ায় অম্লমধুর স্বাদের একটি জাত পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। অবশ্য তেঁতুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও কম হয় না! খেলে নানা ক্ষতি হয়Ñ এমন রটনা আছে। তেঁতুল খেলে, কেউ কেউ তো বলেন, রক্ত পানি হয়ে যায়। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদতে তেমন কিছুই হয় না। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলছে, তেঁতুলের রয়েছে প্রচুর ভেষজ ও পুষ্টিগুণ। তেঁতুল হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে খুব উপকারী। দেহে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। হৃদরোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী। রক্তে কোলস্টেরল কমায়। শরীরের মেদ কমাতেও কাজ করে তেঁতুল। এতে টারটারিক এ্যাসিড থাকায় খাবার হজমে সহায়তা করে। শরবত করেও খাওয়া যেতে পারে তেঁতুল। পেটের বায়ু, হাত-পা জ্বালায় এ শরবত কার্যকর পথ্য। তাই তিন-চার দানা পুরনো তেঁতুলের এক কাপ রসের সঙ্গে চিনি বা লবণ মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ভেষজ চিকিৎসকরা। তেঁতুল গাছের বাকলেও উপকার আছে। শুকনো বাকলের প্রলেপ ক্ষতস্থানে লাগালে ক্ষত সারে। ছাল চূর্ণ করে তৈরি রস হাঁপানি ও দাঁত ব্যথায় কাজ দেয়। আয়ুর্বেদীয়, হোমিও, এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় তেঁতুল। তেঁতুল পাতারও আলাদা গুণ। এর রস কৃমিনাশক ও চোখ ওঠা রোগে কাজে আসে। মুখে ঘা বা ক্ষত হলে পাকা তেঁতুল জলে কুলকুচি করলে উপকার পাওয়া যায়। বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো ও রক্তের প্রকোপে তেঁতুল উপকারী। কাঁচা তেঁতুল গরম করে আঘাত পাওয়া স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা সারে। পুরনো তেঁতুল খেলে আমাশয়, কোষ্ঠবদ্ধতা ও পেট গরমে উপকার পাওয়া যায়। পুরনো তেঁতুল খেলে কাশি সারে। পাকা তেঁতুলে খনিজ পদার্থ সব ফলের চেয়ে অনেক বেশি। তেঁতুলে খাদ্যশক্তির পরিমাণ নারিকেল ও খেজুর ছাড়া সব ফলের চেয়ে বেশি। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ১৭ গুণ বেশি। আয়রনের পরিমাণ নারিকেল ছাড়া সব ফলের চেয়ে ৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। অন্যান্য পুষ্টি উপাদান স্বাভাবিক পরিমাণে আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তেঁতুলে মোট খনিজ পদার্থ ২.৯ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ২৮৩ কিলোক্যালরি, আমিষ ৩.১ গ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, শর্করা ৬৬.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৭০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১০.৯ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ৬০ মাইক্রোগ্রাম ও ভিটামিন সি ৩ মিলিগ্রাম। এতসব গুণাগুণ প্রমাণ করে, তেঁতুল হেলা ফেলা করার মতো কোন ফল নয়। একে টক বলে পাশ কাটানো বোকামি হবে বৈকি!
×