ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারের দাম হাসে বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

সারের দাম হাসে বিপ্লব

এমদাদুল হক তুহিন ॥ দেশে সারের দাম হ্রাসের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। ছয় বছরে সারের দাম কমেছে মোট পাঁচবার। তবে এই সময়ে ইউরিয়া সারের তুলনায় নন-ইউরিয়া সারের দাম কমানোর প্রবণতাই ছিল বেশি। ভিন্ন ভিন্ন সারের ক্ষেত্রে দাম কমানোর সর্বোচ্চ হার ছিল প্রায় ৫৮ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ সার ক্রয়ে কৃষকের বেগ পোহাতে হয়নি বিন্দুমাত্র। ফলে কৃষিদ্রব্যের উৎপাদন বেড়েছে ক্রমবর্ধমান হারে। সারের দাম হ্রাসে বিপ্লব ঘটেছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট পাঁচবার বিভিন্ন সারের দাম হ্রাস করেছে, যা বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে বিরল এক দৃষ্টান্ত। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম যখন উর্ধমুখী, ঠিক সে সময় সারের দাম এক মেয়াদে পাঁচবার কমানো চমকপ্রদ ঘটনা। ১৯৯১-৯৬ আমলে সারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কৃষকদের আন্দোলনের একপর্যায়ে বিএনপি সরকার আন্দোলন দমাতে কৃষকের বুকে গুলি করে। মারা যান ১৭ কৃষক, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সার কেলেঙ্কারীর কালো অধ্যায় নামে পরিচিত। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার উৎপাদন করে, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে সারের দাম কমিয়ে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সারের দাম কমাতে শুরু করে। এ সারের দাম কমানোর কারণে কৃষক পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬ সালের মতো বর্তমান আমলেও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। সারের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সারভেদে অর্ধেকেরও বেশি মূল্য কমানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ে সুষম সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে ইউরিয়ার তুলনায় নন-ইউরিয়া সারের দাম কমানোর প্রবণতাই ছিল বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সরকারে সফলতাগুলোর মধ্যে পর পর পাঁচবার সারের দাম হ্রাস সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। অনেকেই মনে করেন, নন-ইউরিয়া সারের দাম কমানো সরকারের বিশেষ দক্ষতার প্রতিফলন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন সারের দাম মোট পাঁচবার হ্রাস করে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা হয়েছে। বিশেষ করে নন-ইউরিয়া সারের মূল্য যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কেজিপ্রতি ৮০-৯০ এমনকি ১০০ টাকা দরে বিক্রি হতো; সেই সার বর্তমানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে ডিএপি ২৫ টাকা কেজি, টিএসপি ২২ টাকা কেজি এবং এমওপি ১৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকপর্যায়ে বহুল ব্যবহৃত ইউরিয়ার বর্তমান মূল্য কেজিপ্রতি ১৬ টাকা। নন-ইউরিয়া সারের দাম কমানোর ফলে ইউরিয়ার পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সারের ব্যবহার মাঠপর্যায়ে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের এই যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে ফসল উৎপাদনে কৃষকেরা সুষম সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে মাঠপর্যায়ে ফসলের পোকামাকড় এবং রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফসলের উৎপাদন কয়েক বছরে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বর্তমান সরকারের অনবদ্য সাফল্য। বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার- এ যেন তার উজ্জ্বল এক অনন্ত দৃষ্টান্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, বর্তমান সরকারের সফলতাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সারের দাম হ্রাস। নন-ইউরিয়া সারের দাম কমানো সরকারের বিশেষ দক্ষতার প্রতিফলন। কৃষকের জীবনমানের পরিবর্তন আনয়নে সারের দাম কমিয়ে সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ও কাক্সিক্ষত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সার কৃষকপর্যায়ে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে এই সারের মূল্য কেজিপ্রতি ২২ টাকা। কৃষকের কাছে অধিক ব্যবহৃত এই নন-ইউরিয়া সারের দাম কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। শতকরায় টিএসপি সারের দাম কমানো হয়েছে ৪৫ টাকা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কৃষকপর্যায়ে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। বর্তমান ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই সারের দাম হ্রাস পেয়ে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি সারটির দাম কমেছে ২০ টাকা। শতকরায় ডিএমপি সারের দাম কমানো হয়েছে প্রায় ৪৫ টাকা। অন্যদিকে, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষকপর্যায়ে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বর্তমান মেয়াদে সারটির দাম কেজিপ্রতি ১৫ টাকা। সারটির দাম কমানো হয়েছে কেজিপ্রতি ২০ টাকা, যা বর্তমান মূল্যের চেয়েও পাঁচ টাকা বেশি! শতাংশিক হিসাবে এই সারের দাম কমেছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। কৃষকের কাছে অধিক পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের দাম তুলনামূলক দৃষ্টিকোণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষকপর্যায়ে ইউরিয়া সারের দাম ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে তা ২০ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১১ সালের ১ জুন ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি করে ২০ টাকা করা হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম ২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে, যা বর্তমানে কার্যকর। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর সর্বশেষ ডিএপি সারের দাম কমানো হয়, যা ২০১৪ সালের ১ নবেম্বর থেকে কার্যকর হয়ে বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ কৃষকপর্যায়ে ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের মূল্য প্রতি কেজি ২৭ থেকে কমিয়ে ২৫ টাকা এবং ডিলারপর্যায়ে প্রতি কেজি ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ২৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও মাঠপর্য়ায়ে সারের দাম অধিক হারে আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে এক টাকা বেশি হারে ইউরিয়া প্রতি কেজি ১৭ টাকা দরে, ২ থেকে ৪ টাকা বেশি হারে ডিএপি প্রতি কেজি ২৯ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য সারের ক্ষেত্রেও একই ভাবে অতিরিক্ত দাম আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। ইউরিয়া সারের নির্ধারিত খুচরা বাজার মূল্য বস্তাপ্রতি ৮০০ টাকা হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারের দাম কমানোয় তারা বর্তমান সরকারের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। তাদের মতে, তারা মুক্তি পেয়েছেন বিগত আমলের সার কেলেঙ্কারীর মতো ঘটনা থেকে। পূর্বাপর সময়ের তুলনায় কম সময়ে কম দামে হাতের নাগালে সার পাওয়া যাচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামের কৃষক জুয়েল বলেন, ‘বিএনপি যখন ক্ষমতায় আছিল, তখন এলাকার কোনোহানে (কোথাও) সার পাইতাম না। ফসলি ক্ষেত বাচাইবার লাইগা এই থানা (উপজেলা) থাইক্যা হেই থানা (উপজেলা) ঘুইর‌্যা বেড়াইতাম। পাগলের মতো কত ঘুরছি তা কেম্নে (কিভাবে) বুঝাইবাম? আর এহন শেখের বেটি সারের দাম আম্গোর কথা বিবেচনা কইরা অনেক কমাইছে। এহন সারের অভাব নাই। হের লাইগ্যা শেখের বেটির উপরে আল্লাহ সদয় হইব।’ বরিশালের কৃষক শামিম জানান, সার নিয়ে এখন বলতে গেলে সরকারের সফলতার কথাই বলতে হবে। সার কেলেঙ্কারীর কথা সবার জানার কথা, আর এখন সকল সারই আমাদের হাতের নাগালে। সারের দাম কমানোতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ফসল উৎপাদন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। সরকারের প্রতি আমাদের মতো প্রতিটি মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারই অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। সরকার কর্তৃক সারের দাম হ্রাস সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশনের সচিব রিয়াজ আহমেদ বলেন, সারের দাম কমানোর ফলে ডিলারদের আগের তুলনায় কম বিনোয়োগ করতে হচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে অর্থের বিনিয়োগ প্রসারিত হয়েছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক। কোন কোন ক্ষেত্রে সারের অতিরিক্ত দাম আদায়ের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম আদায়কৃতরা নিবন্ধিত ডিলার নন। তারা কোন না কোন ডিলারের কাছ থেকে কিনে এনে অবৈধভাবে উচ্চদামে সার বিক্রি করছেন। ইউরিয়া সারের সরকার নির্ধারিত মূল্য বস্তাপ্রতি ৮০০ টাকার বেশি আদায়ের কোন সুযোগ নেই। উপজেলা সার মনিটরিং কমিটি বিষয়টি নজরে রাখবে বলে আমার আশাবাদ।
×