ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

বিএনপি নেতারা কী ভাবেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

বিএনপি নেতারা কী ভাবেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

নাম ধরে কোন রাজনৈতিক নেতা সম্বন্ধে আলোচনা মানেই এই নয় যে, তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হলো। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা আসলে রাজনৈতিক আলোচনা। অবশ্য অনেকে মনে করেন যে জাতীয় নেতাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। আমরা এখানে আলোচনা করব বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সাহেব সম্বন্ধে দুইজন বিএনপি নেতা কী লিখেছিলেন সেই সম্বন্ধে। বিএনপির এক শীর্ষ স্থানীয় নেতা মওদুদ আহমদ সাহেব লিখেছিলেন যে, জিয়াউর রহমান সাহেবের নির্দেশ ছিল প্রতিটি মন্ত্রীর প্রতি যে প্রতিমাসে তিন লাখ করে টাকা দিতে হবে তাঁকে। এটা মওদুদ সাহেব লিখেছেন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা লেখেননি। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যাঁর নাম জড়িত ভাঙ্গাবাক্স আর ছেঁড়া গেঞ্জির সঙ্গে। তাঁর এ কেমন নির্দেশ! জানি যে তাঁর সমর্থকরা বলবেন যে এই টাকা তিনি নিজে নেননি। এই টাকা দলের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ইত্যাদি। যে যাই বলুন না কেন এটা স্বীকার করতেই হবে যে সরকারী অর্থের এমন ব্যবহার বড় ধরনের বেআইনী কাজ। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধের সংকলন শফিক রেহমান সাহেবের বই ‘যায়যায়দিন’ যেটা ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। শফিক রেহমান সাহেব বিএনপির একজন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী নেতা। এই বইয়ের কিছু কিছু কথার উল্লেখ করব আমরা। কথাগুলো তিনি লিখেছেন। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কেউ লেখেননি। শফিক সাহেব লিখেছেন যে, ‘মার্কিনদের মন জয় করার ব্যাপারে খন্দকার মোশতাকের চেয়ে জিয়া সাহেব এগিয়ে।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিনদের ভূমিকার কথা আমাদের সবার জানা। এই মার্কিনদের মন জয় করা জিয়া সাহেব সম্বন্ধে জনগণের কী ভাবা উচিত। বইটার আর এক অংশে শফিক সাহেব লিখেছেন যে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগান সাহেব বলেছেন যে, তিনি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার বেশি মূল্য দেবেন অর্থাৎ আমাদের প্রেসিডেন্ট জিয়ার পৌষ মাস।’ কোন মন্তব্য না করাই ভাল। শফিক সাহেব জিয়া সাহেবের আমলে বিজয় দিবস সম্বন্ধে লিখেছেন। সরকার পরিচালিত ও সরকার অনুগত কোন পত্রিকায় বা রেডিও-টেলিভিশনে উল্লেখ করা হতো না যে, পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল। তিনি পরিহাস ছলে বলেছেন যে, আমরা যদি বিজয়ী হয়ে থাকি তবে পরাজিত হয়েছিল কে? পাকিস্তান যাতে মনঃক্ষুণœ না হয় এ জন্য জিয়া সরকারের প্রচার মাধ্যম পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করত না পরাজিত শক্তি হিসেবে। তিনি আরও লিখেছেন যে, যতদিন বিজয় দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে ততদিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত অনুষ্ঠানে আসেনি। পাকিসস্তানকে খুশি করার জন্য জাতীয় দিবসকে বিজয় দিবস থেকে আলাদা করা হয় এবং সেটা করা হলে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত অনুষ্ঠানে আসতে শুরু করেন। শফিক সাহেবের ভাষ্যানুযায়ী জিয়া সাহেব ছিলেন মার্কিনদের প্রিয়পাত্র এবং তিনি পাকিস্তানীদের খুশি করার জন্য নিজ জাতির অহঙ্কারকে ভূলুণ্ঠিত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। একটি পত্রিকায় দাবি করা হয়েছিল যে, তারা একজন পাকিস্তানী জেনারেলের একটা চিঠি পেয়েছিল যেখানে জিয়া সাহেবকে প্রশংসা করা হয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে ভাল কাজ করার জন্য। এখন কথাটা হচ্ছে এই যে, শফিক সাহেবের বই পড়ার পরে কেউ যদি পত্রিকাটির দাবি বিশ্বাস করে তবে তাকে দোষ দেয়া যায় কি? তাহলে প্রকৃত অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে। মার্কিনদের প্রিয়পাত্র ও পাকিস্তানীদের তোষামোদকারীদের সম্পর্কে যদি কেউ ভাবে যে, এরা পাকিস্তানীদের স্বার্থে ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল তবে কি তাদের দোষ দেয়া যাবে? যদি কেউ ভাবে যে, পাকিস্তানীদের স্বার্থেই এরা জামায়াত ইত্যাদি শক্তিদের পুনর্বাসিত করেছিল তবে ওরা যে ভুল ধারণা করেছিল তা কি বলা যাবে? বঙ্গবন্ধু হত্যাÑ এসব পরিকল্পনার অংশ এমন যদি কেউ ভাবে তবে বলা যাবে ওরা ভুল ভেবেছিল! শফিক সাহেব লিখেছেন যে, আওয়ামী লীগের ডাকে অনুষ্ঠিত সফল হরতাল সম্বন্ধে সরকারী প্রচার মাধ্যম লিখেছে ও বলেছে হরতাল হয়নি। শফিক সাহেবের ভাষ্যানুযায়ী সরকারী সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছিল যেজন্য জনগণ বিবিসির সংবাদ শুনত। আরও হাসির ব্যাপার এই যে, সরকারী সংবাদ মাধ্যমগুলো আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ না করে বলত ‘একটি দলের আহ্বানে।’ মেয়র হাসনাতের লোকেরা হকিস্টিক হাতে বিএনপির হয়ে হরতাল নষ্ট করার চেষ্টা করত। হরতালের সময় দেখা যেত রিক্সার কনভয়। কয়েকটি রিক্সা একসঙ্গে চলত আর প্রতিটি রিক্সায় থাকত তিনজন করে ষ-ামার্কা লোক। এরা হরতাল নষ্ট করার চেষ্টা করত। জিয়াউর রহমানের সমর্থকরা তাঁকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা’ বলে পরিচিত করার চেষ্টা করেন। বিএনপিরই বুদ্ধিজীবী নেতা শফিক সাহেবের লেখায় জিয়া সাহেবের গণতন্ত্র চর্চার যে বর্ণনা পড়লাম তাতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে দিতে হয়। আর তাঁর নিজের দলের মানুষদের সঙ্গে তিনি কী আচরণ করতেন? শফিক সাহেব লিখেছেন যে, নিজের দলের লোকদের তিনি রেফ্রিজারেশনে রাখতেন। আওয়ামী লীগ হরতাল ডাকলে তিনি তাদের রেফ্রিজারেশনের বাইরে আনতেন। হরতাল শেষ হয়ে গেলে তিনি তাদের আবার রেফ্রিজারেশনে নিয়ে যেতেন। আদর্শ গণতান্ত্রিক আচরণই বটে। শফিক সাহেব লিখেছেন, কিভাবে পুলিশের সাহায্যে একদল তরুণ লোকের গাড়ি আটকিয়ে হেডলাইটের কাঁচের অর্ধেক কালো রং করার জন্য টাকা আদায় করত। সরকারী আদেশেই নাকি এসব করা হচ্ছিল। কাগজের অস্পষ্ট লেখায় সরকারের আদেশ দেখাচ্ছিল যুবকরা। এভাবে জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট নওজোয়ানরা পয়সা উপার্জন করছিল। এই পয়সার কোন হিসাব ছিল না। এভাবেই তরুণদের দুর্নীতির পক্ষে নামানো হয়েছিল। এর অগ্রণী জিয়া সাহেব। আজ তরুণ আর ছাত্রসমাজ কোথায় নেমে গিয়েছে। সবাই কি ভুলে গেছে যে এর শুরু কিভাবে হয়েছিল! ফেরদৌস কোরেশীর দল কিভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন শফিক সাহেব। দল বলতে ফেরদৌস কোরেশী একাই। এমনি সব দল যোগ দিয়েছিল বিএনপিতে। অবশ্যই এই দলে যোগ দিয়েছিল ডানপন্থী মুসলিম লীগ আর বামপন্থী বলে পরিচিত ভাসানী ন্যাপ। এঁরা একসঙ্গে হলো কী করে? মনে পড়ে জর্জ হেগেলের সেই অমৃত বাণী ‘টু এক্সট্রিমস উইল অলোয়েজ গেট টুগেদার।’ এদের একতার কারণ ভারতবিরোধী জিগির আর আওয়ামী বিরোধিতা। ১৯ দফা কে পড়েছিল? কোন রকমের ইতিবাচক মনোভাব ছাড়াই শুধু নেতিবাচক জিগির তুলেই এরা অনেকদিন টিকে থাকল। তারেক রহমানের বঙ্গবন্ধুবিরোধী বক্তব্য দল ধরে রাখার প্রচেষ্টা কিনা কে জানে। এসব বক্তব্যের পেছনে কোন সত্যতা নেই। কিন্তু আবেগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক। খন্দকার সাহেবের মন্ত্রিত্ব হারানোর প্রলাপ আবেগ সৃষ্টি করেছিল। শফিক সাহেবের বক্তব্য অনেকদিন আগের কিন্তু জাতির জন্য শিক্ষণীয় । কিন্তু মানুষ এসব কথা ভুলে গেছে, শফিক রহমানও সবই ভুলে গেছেন। মনে পড়ে ফ্রেডারিক নিচির (ঋৎরবফৎরপয ঘরবঃুংপযব) মূল্যবান উক্তি’ ‘মানুষের স্মৃতিশক্তি স্বল্পস্থায়ী।’ লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
×