ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারি হচ্ছে ওদের আর্তনাদে

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫

বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারি হচ্ছে ওদের আর্তনাদে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ অশীতিপর আবু তাহেরের গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া থানা এলাকায়। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী মাহেরা বেগমের পা ভাঙ্গার চিকিৎসার জন্য ঢাকা আসেন। শনিবার রাতে তিনি গাবতলী বাস টার্মিনালে নামেন স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে। গাবতলী থেকে বাসে উঠে পুরানো ঢাকার হাজারীবাগে এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন। বাসটি বেড়িবাঁধ এলাকায় গেলে অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হন তিনি তার স্ত্রী ও বড় ছেলে আবু বকর। বাস থেকে নামতে গিয়ে পা ভেঙ্গে যায় আরেক ছেলে সুজনের। ওই বাসে থাকা আরও চার যাত্রী মারাত্মক দগ্ধ হয়েছে। ওই বাসের পরিবারের চার সদস্যসহ ৮জনের ঠিকানা এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে। ওই দিনই মৎস্য ভবনের সামনে অবরোধকারীরা পুলিশের বাস লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ পুলিশের চার সদস্য মারাত্মক দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মতো অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়েছেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সাথী আক্তার (১৯) ও যুথি আক্তার (১৯)। কষ্ট ও যন্ত্রণায় ওরা হাসপাতালের বেডে ছটফট করছেন। এ নিয়ে বিএনপি অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমার আগুনে প্রায় ৩০ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এদের কারও সারা মুখম-ল, কারও সারা শরীর, কারও মুখ ও কারও পা দগ্ধ হয়েছে। অবরোধের আগুন পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। আপনজনকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য দিনরাত নির্ঘুম কাটাচ্ছেন। এ নিয়ে দিশাহারা পোড়া মানুষের স্বজনরা। দগ্ধ বৃদ্ধ আবু তাহেরের ছোট ছেলে সুজন জানান, গ্রামের বাড়িতে মা মাহেরা বেগমের পা ভেঙ্গে যায়। এ নিয়ে মা বার বার বাবাকে বলেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পায়ে চিকিৎসা করাবেন। পরে বাবা মা ও তার দুই ভাইকে নিয়ে শনিবার রাতে গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনালে নামেন। পরে হাজারীবাগে এক আত্মীয়ের বাড়িতে তারা ব্রাদার্স পরিবহন নামে একটি বাসে করে যাচ্ছিলেন সেখানে। রাত সাড়ে নয়টার দিকে অবরোধকারী কয়েক যুবক তাদের বাস লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। এতে বাসে আগুন ধরে যায়। এ সময় অনেক যাত্রী জানালা দিয়ে বের হয়ে গেলেও বাবা, মা, বড় ভাই আবু বকর ও আরও চার বাসযাত্রী আগুনে পুড়ে যায়। তারা বাস থেকে বের হতে পারেনি। কোন রকমে দৌড়ে এসে বাস থেকে নামতে গিয়ে আমার পা ভেঙ্গে যায়। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এই বাসের আগুনে বাবা, মা ও দুইভাই দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এ ঘটনায় দিশাহারা দগ্ধ বৃদ্ধ আবু তাহেরের স্ত্রী মাহেরা বেগম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার চিকিৎসা করাতে এসে মানুষটা (স্বামী আবু তাহের) এভাবে পুড়েছে। বড় ছেলে আবু বকরের হাত ঝলছে গেছে। ছোট ছেলে সজলের পা ভেঙ্গেছে। এখন আমার কি হবে। ওরা (অবরোধকারীরা) কেন এভাবে আমার পরিবারের ওপর আগুন দিল। ওদের কি বাপ-মা নেই। ছেলে-সন্তান নেই। আল্লাহ যেন ওদের বিচার করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গাবতলী বেড়িবাঁধের ওই ঘটনায় বৃদ্ধ আবু তাহেরের ১৪ ভাগ শরীর দগ্ধ হয়েছে। তার বড় ছেলে আবু বকরের হাত ঝলসে গেছে। এ ঘটনায় শুধু আবু তাহেরের পরিবারের সদস্যরাই নয়, ওই বাসে চার যাত্রী দগ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী বিল্লাল হোসেনের ২৫ ভাগ ও মোঃ আরমানের ১২ ভাগ শরীর দগ্ধ হয়েছে। নূরজাহান (৩০) নামে আরেক যাত্রীর ৪ ভাগ ও তার মেয়ে রিফাত (২) ও মনোয়ারা বেগম (৩৫) সামান্য দগ্ধ হয়েছে। দগ্ধ নূরজাহানের মেয়ে রিতু জানান, গাবতলী থেকে ব্রাদার্স পরিবহনে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার সময় কে বা কারা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার মা ও ছোট বোন আহত হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্শ সঙ্কর পাল জানান, দগ্ধদের মধ্যে বিল্লাল হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কারণ তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এর আগে শনিবার রাত সাড়ে ৮টার পর রাজধানীর রমনা এলাকার মৎস্য ভবনের কাছে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) সামনের সড়কে অবরোধকারীরা পুলিশের একটি বাস লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে মারাত্মক দগ্ধ হয়ে কনস্টেবল শামীম (২৫), বাসচালক কনস্টেবল মোর্শেদ (৫০), কনস্টেবল মোহাম্মদ লিখন (২৫), কনস্টেবল বদিয়ার (২৫) ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদকে (৪৫) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরে গভীররাতে কনস্টেবল শামীমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, আহত চার পুলিশ সদস্যের শরীর ১০ থেকে ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে। আহত এসআই আবুল কালাম আজাদ জানান, শাহবাগ বারডেম হাসপাতালের সামনে ডিউটি শেষে ৩০-৪০ পুলিশ সদস্য নিজস্ব বাসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ফিরছিলেন। এ সময় কয়েক যুবক একটি মোটরসাইকেলে এসে ওই গাড়িতে একটি পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। এতে চালক মোর্শেদ দগ্ধ হন। পেট্রোলবোমায় মোর্শেদের মুখ ও দুই হাত ঝলসে যায়। তিনিসহ কয়েক পুলিশ সদস্য দগ্ধ হন। ওদিন রাত ১০টার দিকে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া। এ সময় তিনি বলেন, পুলিশের ওপর হামলাকারীদের হুকুমদাতাসহ জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে রবিবার দুপুরে মারাত্মক দগ্ধ কনস্টেবল শামীমকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যানবাহনে যারা পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ মারছে, দগ্ধ করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ সময় পুলিশের আইজি শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন। রবিবার দিনে-দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিএনপির অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমায় বাসযাত্রী ইডেন কলেজের চার শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে সাথী আক্তার (১৯) ও যুথি আক্তার (১৯) নামে দুই ছাত্রী দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছে। আহত ছাত্রী মুক্তি জানান, রবিবার দুপুর পৌনে দুইটার দিকে সংসদ ভবনের খেজুরবাগান এলাকায় ১০ নম্বর গেটের কাছে বিকল্প পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো- ঘ- ১১- ২৬৬৬) যাচ্ছিল। এ সময় একটি মোটরসাইকেল থেকে একজনকে ওই বাসের জানালা দিয়ে কিছু ছুড়ে দিতে দেখেন। পরে তিনি লাফিয়ে পড়েন। এতে তার বাম পা মচকে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসে আগুন জ্বলে ওঠে। নামার সময় সাথীর দুই পা ও যুথির এক পা আগুনে দগ্ধ হয়। টানা অবরোধে সব মিলে রাজধানীতে পেট্রোলবোমা আতঙ্ক বাড়ছে। অবরোধে এ পর্যন্ত রাজধানীতে শতাধিক বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে মগবাজারে একটি প্রাইভেট কারে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আবুল কালাম আজাদ নামে এক চালক নিহত হয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাসে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে পেট্রোলবোমা। এছাড়া এই বোমা বানানোর উপকরণও সহজলভ্য। কম খরচে বানানো যায় বলে অবরোধকারী দুর্বৃত্তরা এখন এই দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই ধরনের কাজে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা তো যুক্ত রয়েছেন। এর বাইরে অনেকেই টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে থাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে যারাই এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
×