ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় কবিতা উৎসব ২১৫

শিল্প আর স্লোগানে শৈল্পিক মিলন, আসছেন আট দেশের কবি

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

শিল্প আর স্লোগানে শৈল্পিক মিলন, আসছেন আট দেশের কবি

মোরসালিন মিজান ॥ কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা,/ গবেষণাগারে নিয়ে খুলে দেখো/ তার সব অণু-পরমাণুজুড়ে কেবলি/ জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।/ মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,/ সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন...। এই শিল্পের এই স্লোগানের যে কবিতা, আবার হবে। স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সেমিনার চলবে টানা দুই দিন। সে জন্য প্রস্তুত হচ্ছে জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চ। এবার ২৯তম আয়োজন। আয়োজক- জাতীয় কবিতা পরিষদ। বরাবরের মতোই ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি মুখর হয়ে ওঠবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তন। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শুরুটা সেই ’৮৭ সালে। বড় দুঃসময় তখন। এরশাদের স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত দেশ। গণতন্ত্র নির্বাসনে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত। রাজনীতির লোকেরা কিছুটা যেন ক্লান্ত। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়Ñ ‘তখন আমাদের কবিদের কাঁধে ইতিহাস দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। আমরা ভাঙ্গনের ওপরে নির্মাণের জন্য এগিয়ে আসি। শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসব।’ প্রথম আয়োজন হলেও, এ উৎসব স্বৈরাচারের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে দেশের সব বরেণ্য কবিরা এক মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। কবিতার এই শক্তি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলকে নতুন গতি দিয়েছিল। এর পর কখনও কখনও ছন্দপতন হয়েছে বটে, থেমে থাকেনি। সেই ধারাবাহিকতায় এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৫। দুই দিনব্যাপী উৎসবে যোগ দেবেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কবিরা। বিদেশ থেকেও আসছেন বিভিন্ন ভাষার কবি। কেউ নিজের লেখা কবিতা পড়বেন। কেউ আবৃত্তি করবেন প্রিয় কবি থেকে। বলবেন কবিতার কথা। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হবে। চলবে সেমিনার সিম্পোজিয়াম। সবই কবিতাকে ঘিরে। এবার এমন এক সময়ে জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে যখন সারাদেশে রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি নির্মম নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে মারছে মানুষ। যেন সেই একাত্তরের হায়েনা রূপে এরা ফিরে এসেছে। কবির ভাষায়- জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন। এই শকুনদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কবিতা। উৎসবে মুখ্য হয়ে ওঠতে পারে প্রতিবাদ। ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা উৎসব সঙ্গীতও প্রতিবাদকে ধারণ করেছে। আয়োজক সূত্র জানায়, উৎসবের এবারের স্লোগান ‘জাগো সম্ভাবনায় জাগো কবিতায়’। সৈয়দ শামসুল হক রচিত উৎসব সঙ্গীতের কিছু কথা এ রকম- জ্বলছে আগুন হিংসায় আজ ফালগুন ফিরে যায়/ দগ্ধ সময় চিরতরে নয়- কবির কণ্ঠ কবিতায়।/ কবিতায় তবে প্রতিরোধে আজ পুষ্প ফুটুক সত্তায়।/ জাগো সম্ভাবনায়, জাগো কবিতায়Ñ কবিতায়- জাগো...। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, এবারও উৎসব উদ্বোধন করবেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হবে প্রথম দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। এর পর উৎসবস্থলে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত পরিবেশিত হবে। মঞ্চের আয়োজন শুরু হবে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ ও ঘোষণা পাঠের মধ্য দিয়ে। পরে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা। বর্তমান সময় ও কবিতার দায় ব্যাখ্যা করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করবেন সৈয়দ শামসুল হক। উৎসবে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করতে, সুন্দরের চর্চার পক্ষে বলতে সারাদেশ থেকে আসবেন কবিরা। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসবেন। বিখ্যাতদের নয় শুধু, অখ্যাত কবিরাও মিলনমেলায় যোগ দেবেন। স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন। আবৃত্তি করবেন। কবিতা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন দেশ ও ভাষার কবিদের উপস্থিতি। গত কয়েক বছর এ উপস্থিতি কম থাকলেও এবার তা বাড়বে। আয়োজকরা জানান, উৎসবে ৮ দেশ থেকে যোগ দেবেন প্রায় ২৫ জন কবি। ভারত থেকে যারা আসছেন, তারা আগেও এসেছেন উৎসবে। বাকিরা প্রথমবারের মতো। এবার মালয়েশিয়া থেকে আসছেন ছয়জন কবি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির রাজ কবি আহমেদ কামেল, আরবাক বিন ওথম্যান, রাজা রাজেশ্বরী সীতা সীথা রামন, ফাজিলাহ হুসাইন, ওমর ওজাইর ও লিলি সিতি সুতান লক্ষন্দর। ইকোয়েডর থেকে আসছেন মারিয়া বারেরা। বেলজিয়াম থেকে যোগ দেবেন জারমেইন ড্রুগেনব্রুট। ডেনমার্ক থেকে আসছেন সিন্ডি লিন ব্রাউন। সুইডেন থেকে আসছেন উত্তর ইউরোপের উল্লেখযোগ্য একটি কবিতার কাগজের সম্পাদক পিটার নেইবার্গ। সুইজারল্যান্ড থেকে আসছেন জার্মান ভাষার কবি টবিয়াস। আমেরিকা থেকে আসছেন চিনা ভাষার কবি জ্যামি শ্যু। প্রতিবারের মতোই থাকছেন ভারতবর্ষের কবিরা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসছেন উৎপল কুমার বসু, আশিস স্যানাল, মৃণাল বসুচৌধুরী, রাতুল দেব বর্মণ, সুবোধ সরকার, বীথি চট্টোপাধ্যায়, সুতপা ভট্টাচার্য, সৈয়দ হাশমত জালাল ও শ্রীজাত। আসাম থেকে আসছেন চন্দ্রীমা দত্ত। ত্রিপুরা থেকে যোগ দেবেন জোগমায়া চাকমা। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। গত কয়েকদিন টিএসসির উৎসব দফতরে গিয়ে দেখা যায়, নিবন্ধনের কাজ এগিয়ে চলছে। একাধিক কর্মী সকাল থেকে রাত অবদি এখানে কাজ করছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের যারা উৎসবে কবিতা পড়তে আগ্রহী তারা নাম নিবন্ধন করছেন। অবরোধ হরতালের কারণে কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেও, উৎসব সফল করার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানান জাতীয় কবিতা উৎসবের আহ্বায়ক কবি মুহাম্মদ সামাদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের সাধ্য সীমিত। যতটা চাই, সব সময় হয়ে ওঠে না। তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই। বছরের শুরু থেকেই উৎসব আয়োজনের নানা প্রস্তুতি চলতে থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত কয়েক বছরের তুলনায় আয়োজনটি সমৃদ্ধ হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৫-এর চরিত্রটি কেমন হতে পারে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, এখন রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। পোড়ানো হচ্ছে। কবিতা সব সময় বর্বরতার বিরুদ্ধে। উৎসব থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হবে। মানবিক পৃথিবীর পক্ষে জয়গান গাইবেন কবিরা। উৎসবের সেøাগান ‘জাগো সম্ভাবনায় জাগো কবিতায়’ ব্যাখ্যা করে আয়োজকরা বলেন, বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের সীমাহীন অভীপ্সা, লোভ ও আত্মস্বার্থপরতা আক্রান্ত করছে ন্যায়, সত্য, সহমর্মিতা ও মানবিক বোধের শিল্পীত প্রকাশকে। সমাজ সংস্কৃতি ও শিল্পযাত্রার এহেন প্রেক্ষাপটে, আমাদের আদি কবি বাল্মিকীর প্রেমের প্রতি পক্ষপাত, চ-ীদাসের অমর উচ্চারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’, ভরতচন্দ্রের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, গ্যাটের ভালোবাসার জন্যে অবসর প্রার্থনা, রবীন্দ্রনাথের প্রেম-প্রকৃতি ও শান্তির আরাধনা, কাজী নজরুলের ‘বল বীর-বল উন্নত মম শির!’ এবং জীবনানন্দের মৃত্তিকা সংলগ্নতার অপার সম্ভাবনাকে আমরা নতুন করে জাগিয়ে তুলতে চাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তার আজন্মলালিত স্বপ্ন, জয়নুল আবেদিনের রুচিশীলতার আকাক্সক্ষা, কামরুল হাসানের মানুষরূপী জানোয়ারের বিনাস কামনা এবং কাইয়ুম চৌধুরীর অপরূপ সবুজ বাংলার সুন্দরের সম্ভাবনাকে আমরা কবিতায় ভরিয়ে দিতে চাই। তাই আমাদের সেøাগান ‘জাগো সম্ভাবনায় জাগো কবিতায়’।
×