ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিনামূল্যের পাঠ্যবই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

বিনামূল্যের পাঠ্যবই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধের ফলে সৃষ্ট অরাজকতা ও ডামাডোলের মধ্যেই নতুন বছরের পাঠ্যবই নিয়ে ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত অসাধুচক্র। গণমাধ্যমসহ দেশের মানুষের নজর যখন হরতাল-অবরোধের দিকে তখন বিনামূল্যের পাঠ্যবই উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে কালোবাজারিরা। রাজধানীর বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর বইয়ের বাজার ছাড়াও বিভিন্ন লাইব্রেরীতে ঘুরে বই বিক্রির প্রমাণও পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে ইসলামিয়া লাইব্রেরী থেকে কয়েক হাজার পাঠ্যবই জব্দ করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এদিকে সরকারের দেয়া বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বেশকিছু জেলা ও উপজেলায়। অথচ পাঠ্যবই বিতরণে টাকা নেয়ার বিষয়ে রয়েছে সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, বছরের প্রথম দিন থেকেই হরতাল-অবারোধের নামে অরাজকতায় পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। পেট্রোল বোমা হামলার আতঙ্কে এমনিতেই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কম আসছে। শহরের বিদ্যালয় বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি কমে গেছে। এ অবস্থায় মানুষের নজর তেমন নেই পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রমের দিকে। আর এই সুযোগেই সক্রিয় হয়েছে অসাধুরা। জানা গেছে, পাঠ্যবই সঙ্কটের মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কালোবাজারে বই বিক্রির তথ্য এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। বিষয়টি টের পেয়ে সক্রিয় করা হয়েছে পাঠ্যবই সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটিকেও। তবে কালোবাজারে বই বিক্রি দেখার জন্য কোন উদ্যোগ নেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। কোথাও বই বিক্রির খবর পেলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা কেবল র‌্যাব, পুলিশকে ফোন করে অভিযানের উদ্যোগ নেয়। এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মোসতাক আহমেদ ভূঁইয়ার কাছে বই বিক্রির ওপর নজরদারি না রাখার বিষয়টি জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, সেভাবে নজরদারি করা হয় না কখনই। তবে এটা রেগুলার হওয়া প্রয়োজন। নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও। এদিকে রাজধানীর বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকার লাইব্রেরী ঘুরে বই বিক্রির প্রমাণও পাওয়া গেল। অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে তিন সিন্ডিকেট। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, এনসিটিবির একটি চক্র এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও কিছু অসাধু শিক্ষক মিলে চলছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির ব্যবসা। কালোবাজারে প্রতিটি বই ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে চড়া দামে বই কিনছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে চলা ইংলিশ ভার্সন, কিন্ডারগার্টেন ও বাংলা মাধ্যম স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কিছু অভিভাবকও। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক বই ও শিক্ষা উপকরণ পেতে একটু বিলম্ব হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তা বাজারে বিক্রি করছে একটি চক্র। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলঘেঁষা লাইব্রেরীতে এখন মিলছে সরকারী বই। বই বিক্রির ঘটনার প্রমাণ ইতোমধ্যেই পেয়েছে র‌্যাব। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে ইসলামিয়া লাইব্রেরী থেকে কয়েক হাজার পাঠ্যবই জব্দ করা হয়েছে। ইসলামিয়া লাইব্রেরীর ম্যানেজার নজরুল ইসলামসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। পলাতক আছে এর মালিক। র‌্যাব সদস্যরা জানিয়েছেন, ক্রেতা সেজে মোহাম্মদপুরের ইসলামিয়া লাইব্রেরীতে বই চাইলে দোকানের বিক্রেতা প্রতিটি বই ১২০ টাকা ধরে দাম চান। এর আগে তিনি নানা ধরনের প্রশ্ন করেন আমাদের। আমরা কি আসলে ক্রেতা নাকি গোয়েন্দা সংস্থার লোক তা নিশ্চিত হয়েই তিনি বই বিক্রি করতে রাজি হন এবং দাম চান। মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিবছর বাফার স্টক বা আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ৫ শতাংশ বই অতিরিক্ত ছাপা হয়েছে। এবার ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৪ কপি ছাপে সরকার। সে অনুয়ায়ী এবার প্রায় এক কোটি ৬৩ লাখ বেশি বই চাপানো হয়েছে। আর এসব বই প্রয়োজন অনুযায়ী জেলা ও উপজেলায় স্টকে রাখা হয়। কিছু প্রতিষ্ঠানে চাহিদার চেয়ে বেশি বই প্রয়োজন হয়। তখন বাফার স্টক থেকে দেয়া হয়। এছাড়া নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিশেষকালীন চাহিদা মেটানো হয় সেখান থেকে। এই বাফার স্টক থেকেও বই কালোবাজারে যায় বলে অভিযোগ আছে। এদিকে সরকারের দেয়া বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বেশকিছু জেলা ও উপজেলায়। অথচ পাঠ্যবই বিতরণে টাকা নেয়ার বিষয়ে রয়েছে সরকারের নিষেধাজ্ঞা। জানা গেছে, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে ইতোমধ্যেই বেশকিছু এলাকা থেকে বই বিতরণে টানা নেয়ার অভিযোগ এসেছে মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে। অভিভাবকরাও পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষের টাকা নেয়ার বিষয়টি। গাজীপুরের শ্রীপুর, শেরপুরের নকলা, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা ও কয়েকটি উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় একই ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলায় টাকা ছাড়া মাধ্যমিক শ্রেণীর বই মিলছে না বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। বিনামূল্যের সরকারী বই নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিস ও বেশকিছু স্কুলের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। বিশেষ করে উপজেলায় গড়ে উঠা প্রাইভেট স্কুলের সরকারী বই নিতে অফিসকে টাকা না দিয়ে বই পাওয়া অসম্ভব। আবার এমপিওভুক্ত কোন কোন স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বিনামূল্যের সরকারী এই বইয়ের বিনিময়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঝিনাইগাতিতে বই নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। উপজেলার প্রাইভেট স্কুল অরবিট, বর্ণমালা, নর্থ স্টার, ইকরা বিদ্যানিকেতন সূত্র জানায়, টাকা ছাড়া অফিস থেকে বই পাওয়া যায় না। কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বেশ কয়েকটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে বই দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
×