ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর প্রতি ৩ লাখ নাগরিকের জন্য নিজস্ব চিকিৎসক মাত্র একজন ;###;গত ১৪ বছরে নতুন কোন হাসপাতাল হয়নি ;###;উন্নত সেবা নেই, তাই শুধু নিম্নবিত্তরাই আসে এখানে ;###;হাসপাতাল খাতে বরাদ্দ কমছে প্রতিবছর

দুই ডিসিসির হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ॥ নামমাত্র স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

দুই ডিসিসির হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ॥ নামমাত্র স্বাস্থ্যসেবা

আনোয়ার রোজেন ॥ রাজধানীতে বসবাসকারী দেড় কোটিরও বেশি বাসিন্দার স্বাস্থ্যসেবার চাহিদার সিকিভাগও পূরণ করতে পারছে না ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটির নাগরিকের উন্নত সেবার মাধ্যমে স্বাাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে হাসপাতাল, নগর স্বাস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও বাস্তবে তা অনেকটা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রদানে গতি আনতে বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) ভেঙ্গে আলাদা দুটি কর্পোরেশন গঠন করলেও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যাহত হচ্ছে। রাজধানীতে বসবাসকারী নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবায় দুই সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে মাত্র ২টি ও মাতৃসদন কেন্দ্র ১ টি। গত ১৪ বছরে সিটি কর্পোরেশন নিজস্ব উদ্যোগে নতুন কোন হাসপাতাল নির্মাণ করেনি। কর্পোরেশনের নাগরিক স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা এতই বেহাল যে, কমপক্ষে প্রতি ৩ লাখ নাগরিকের বিপরীতে কর্পোরেশনের নিজস্ব চিকিৎসক আছে মাত্র ১ জন। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাতৃসদন নির্মাণের জন্য ডিএনসিরি বরাদ্দ মাত্র ১ কোটি টাকা। অথচ মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। তার ওপর প্রতিবছর বরাদ্দ থাকলেও তিন বছরেও মাতৃসদনের নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি। পরিকল্পনাতেই আটকে আছে মাতৃসদন নির্মাণ কাজ। ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে ডিএসসিসির দুই হাসপাতাল ও একমাত্র মাতৃসদনের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি টাকা। তবে তিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বরাদ্দকৃত অর্থের এক-তৃতীয়াংশও (১ কোটি ৯৭ লাখ) ব্যয় করতে পারেনি। এর ওপর চলতি অর্থবছরে এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে ডিএসসিসি। নগরীর অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড় থাকলেও রোগীর অভাবে অধিকাংশ সময় ওই সব হাসপাতালের অর্ধেকের বেশি শয্যা খালি পড়ে থাকে। দুই কর্পোরেশনের নারী, মা ও শিশুর চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন ও ৫৫ টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থাও বেহাল। সব শ্রেণীর নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হলেও উন্নত সেবা না পাওয়ায় কর্পোরেশনের হাসপাতাল, মাতৃসদন ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কেবল গরিব ও নিম্নবিত্তের সেবাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেবার মান এতটাই খারাপ যে কোন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত লোক সেবা গ্রহণে যেতে রাজি হন না। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য গত ২৬ বছরে (১৯৮৯, ১৯৯০ ও ২০০১ সাল) মাত্র ২ টি হাসপাতাল ও ১ টি মাতৃসদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অবিভক্ত ডিসিসি। যেগুলো বর্তমানে ডিএসসিসির আওতাধীন। গত ১৪ বছরে অবিভক্ত ডিসিসিতে নিজস্ব কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল নির্মিত না হলেও একই সময়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরীতে (প্রায় ৫০ লাখ বাসিন্দা) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) চালু করেছে ৭ টি হাসপাতাল। অথচ খোদ রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে গত ১৪ বছরে কমপক্ষে ১০ টি হাসপাতাল ও কমপক্ষে নতুন অর্ধশতাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করার কথা। বিশ্বের সব দেশেই নগরে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের। সেই অনুযায়ী রাজধানীর মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির। অথচ দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বিপরীতে দুই কর্পোরেশনের নিজস্ব মোট চিকিৎসক আছে মাত্র ৪৯ জন। অর্থাৎ রাজধানীর প্রতি ৩ লাখ মানুষের বিপরীতে দুই কর্পোরেশনের নিজস্ব চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। এক্ষেত্রে চিকিৎসক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও ঢাকার তুলনায় এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির চেয়ে চসিকের নিজস্ব চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেশি। বর্তমানে চসিকের নিজস্ব চিকিৎসকের সংখ্যা ১৩০। সে হিসেবে প্রতি তিন লাখ মানুষের বিপরীতে তাদের নিজস্ব চিকিৎসক আছেন আটজন। যে উদ্দেশ্যে রাজধানীতে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়া হয়েছিল তাও ব্যর্থ হতে চলেছে। দুই কর্পোরেশনের ৯২ টি ওয়ার্ডের মধ্যে এ ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে মাত্র ৪২টিতে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের আহ্বায়ক করে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি থাকার নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে চারজন ডিপ্লোমা চিকিৎসক, চারজন সার্ভিস প্রমোটর ও চারজন বহিরাঙ্গনকর্মী থাকার কথা। তবে নির্বাচিত কাউন্সিলর না থাকায় প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটির কার্যক্রমই বর্তমানে বন্ধ। ছয়টি এনজিও পরিচালিত ৬৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে দুই বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে ১০টি। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেবাদান কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশ ওমেন্স হেলথ কোয়ালিশন নামের একটি এনজিওকে বাদ দেয়া হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, চালু থাকা ৫৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই কমেছে লোকবল। ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিটি কেন্দ্র্রে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদিত লোকবল ছিল ২২ জন। বর্তমানে ছয়জন কমিয়ে তা ১৬ জন করা হয়েছে। এ হিসেবে ৫৫টি কেন্দ্রে লোকবল কমেছে (বন্ধ হওয়া ১০টি সহ) প্রায় এগারো শ’। সেই সঙ্গে কমেছে সেবার মানও। জন্মবিরতির ওষুধ নিয়মিত পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন আরামবাগ ও আজিমপুর নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের কয়েকজন। মাতৃসদনগুলো পরিণত হয়েছে ব্যয়বহুল চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে। বিভিন্ন সেবার বিপরীতে ফি বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণ। দুই বছর আগে এসব কেন্দ্রে নরমাল ডেলিভারির খরচ ছিল ৫০০ টাকা, সিজারিয়ানের জন্য ৬ হাজার টাকা। বর্তমানে এ দুটি সেবা পেতে সাধারণ রোগীর যথাক্রমে ১ হাজার ও ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। মাতৃসেবা স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও সাধারণ রোগের চিকিৎসা ফি ছিল ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিটি সেবার জন্য সাধারণ রোগীকে দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা করে। তবে ফি বাড়লেও এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদনে বাড়েনি সেবার মান। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় কসাইটুলী বংশাল লেনের নগর মাতৃসদন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় গাইনী এ্যান্ড অবস পরামর্শক ডা. নাসরীন বেগমের কক্ষে তালা ঝুলছে। তিনি তখনও আসেননি। তার অপেক্ষায় থাকা কয়েক দরিদ্র রোগী বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন। রোগীর সার্বিক উপস্থিতি কম। এ সময় কাউন্সিলরের কক্ষটিও ফাঁকা পাওয়া যায়। ওই এলকার বাসিন্দা ও আবাহনীর সাবেক ফুটবলার মোঃ তাইজুল ইসলাম জানান, নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্যগত জটিলতার চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে পাওয়া যায় না। ওই ধরনের শিশুকে মিটফোর্ড হাসপাতাল বা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদানের নিয়ম থাকলেও রাতেরবেলা কোন ইমার্জেন্সি রোগীকে ভর্তি করানো হয় না। একই ধরনের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন হাজারীবাগ মাতৃসদনে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েক রোগী। অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রজেক্ট এরিয়া-২’র প্রজেক্ট ম্যানেজার ডাঃ মোঃ আবদুল হান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, মিটফোর্ড বা ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের মতো চিকিৎসা সুবিধা মাতৃসদনে নেই। এজন্য নবজাতকের স্বাস্থ্যগত বড় ধরনের জটিলতা দেখা দিলে ওইসব হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেয়া হয়। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পাওয়া না গেলেই কেবল ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করানো হয় না। আগে আর্থিক স্বচ্ছলতার শ্রেণীভেদে সবুজ, নীল ও লাল- তিন ধরনের কার্ডধারী পরিবারকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদনে স্বল্প ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো। বর্তমানে একমাত্র লাল কার্ডধারীই (দরিদ্র ও হতদরিদ্র) এ সেবা পেয়ে থাকেন। জীবিকা, বাসস্থানের ধরন, বাসা ভাড়া, পরিবারের সদস্য সংখ্যাসহ কয়েকটি আর্থিক ও সামাজিক সূচক অনুযায়ী যেসব পরিবারে মাথাপিছু মাসিক আয় অনুর্ধ ২ হাজার টাকা, নিয়ম অনুযায়ী কেবল তাদেরই এসব কার্ড পাওয়ার কথা। ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিতে এ ধরনের কার্ডধারী দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৭৪টি; যা রাজধানীতে দরিদ্র পরিবারের বাস্তব সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। অবিভক্ত ডিসিসি থেকে পাওয়া ডিএসসিসির নিজস্ব যে দুটি হাসপাতাল ও একটি মাতৃসদন কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রায় সব কটি পদ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে খালি পড়ে আছে। বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয় না, তাই বাধ্য হয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানেই অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। মোট ২৮১ শয্যার পুরনো এসব হাসপাতালে সব শ্রেণীর মানুষের তুলনামূলক স্বল্পখরচ ও অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার কথা। তবে সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রোগী এসব হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ফলে তিনটি হাসপাতালই বর্তমানে সামর্থ্যহীন নিম্নবিত্ত, ভাসমান ও ছিন্নমূল গরিব মানুষের হাসপাতালের তকমা পেয়েছে। তবে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক এসব হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসক, নার্স ও শয্যা সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সুবিধার পাশাপাশি দক্ষ মনিটরিং ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে সব শ্রেণীর নগরবাসী সেসবের সুফল পাবেন। তাছাড়া নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উন্নত চিকিৎসা সুবিধাসমৃদ্ধ নতুন হাসপাতাল নির্মাণ ও ওয়ার্ডভিত্তিক নাগরিক স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো জরুরী। ডিএসসিসির তিন হাসপাতালের সরেজমিন চিত্র ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ॥ হাসপাতালটির অবস্থান পুরান ঢাকার নয়াবাজারে। ১৯৮৯ সালে শ্রমজীবী হাসপাতাল নামে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা হাসপাতালটি মহানগর জেনারেল হাসপাতাল নামে রূপান্তরিত হয় ১৯৯৭ সালে। তিনতলা এ হাসপাতালের বর্তমান শয্যা সংখ্যা ১৫০ হলেও প্রশাসনিক অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সব শয্যায় রোগী ভর্তি করা হয় না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২৬ বছর আগের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ সংখ্যা ৩০টি। এই দীর্ঘ সময়ে চাহিদা ও প্রয়োজন সত্ত্বেও চিকিৎসকের পদ বাড়েনি। উপরন্তু, বর্তমান ৩০টি পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি পদ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে শূন্য পড়ে আছে। এগুলো হলো এ্যানেসথেসিয়া বিভাগের দুইটি পদ, নাক, কান ও গলার রোগ বিশেষজ্ঞের একটি, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞের একটি, হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে একটি এবং মেডিক্যাল অফিসারের দুইটি পদ। হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ আজমল হোসেনই (এ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে সনদপ্রাপ্ত) পালন করেন এ্যানেসথেসিস্টের দায়িত্ব। আবাসিক সার্জনের কোন পদ নেই হাসপাতালের শুরু থেকেই। বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা ২৩। এদের মধ্যে সার্জারি পরামর্শক ডাঃ তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী ও গাইনি পরামর্শক ডাঃ জেবুন নেসা চার বছর ধরে প্রেষনে নিয়োজিত। এছাড়া সরকার নিয়োজিত মেডিক্যাল অফিসার আছেন দুইজন। হাসপাতালে কমপক্ষে ৬০ নার্সের প্রয়োজন, সেখানে বর্তমানে নার্সের সংখ্যা ৩০ জন। রাজধানীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত ১০ বছরে এ হাসপতালের বহির্বিভাগে (আউটডোর) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ছয় গুণ। তবে সে তুলনায় বাড়েনি সেবার মান। ২০০৫ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৩১৫। আর ২০১৪ সালে রোগীর এ সংখ্যা বেড়ে ৯৮ হাজার ৩০৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে চিকিৎসক, শয্যা সংখ্যা ও অন্যান্য সুবিধা কিছুটা বাড়লেও অন্তঃবিভাগের (ইনডোর) তিনটি ইউনিটে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা বাড়েনি। ২০০৫ সালে অন্তঃবিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন ১৩ হাজার ২৭১ জন রোগী। ২০১৪ সালে রোগীর এ সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৮৫২ জন। নিয়মিত সার্জন ও এ্যানেসথেটিস্ট না থাকায় হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সংখ্যাও কমেছে। ২০১১ সালে হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় ৯৯৯টি। তবে সর্বশেষ ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৮৬টি। সোমবার সরেজমিন হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, নিচতলার বহির্বিভাগে রোগীর ভিড় থাকলেও হাসপাতালের ১৫০ শয্যার মধ্যে ৯০টি ফাঁকা। অথচ রাজধানীর সরকারী হাসপাতালগুলোতে অনেক আশঙ্কাজনক রোগীর কপালেও শয্যা জুটে না। হাসপাতালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ছয়টি ওয়ার্ডে রোগী আছেন ৬০ জন। এর মধ্যে মেডিসিন ইউনিটে ২৫ জন, সার্জারিতে ১৯ জন ও গাইনি এ্যান্ড অবস ইউনিটে ১৭ জন। রোগীদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত ও গরিব শ্রেণীর। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে হাসপাতালের ওষুধ কেনার জন্য বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা। কিন্তু ওষুধ কেনা হয় মাত্র ২১ লাখ টাকার। চলতি অর্থবছরেও ওষুধের জন্য এক কোটি টাকার বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়েছে। তবে এবারও তা পুরোপুরি ব্যবহৃত হবে না বলে জানা গেছে। যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারায় চলতি অর্থবছর সার্জিক্যাল দ্রব্যাদি ও রোগীর খাদ্য খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে সার্জিক্যাল দ্রব্যাদির জন্য বরাদ্দ এক কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয় মাত্র ২২ লাখ টাকা। আর রোগীর খাদ্যের জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ লাখের মধ্যে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই দুই খাতে বরাদ্দ কমিয়ে যথাক্রমে ৭৫ লাখ ও ২৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ আজমল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় ১৫০ শয্যার সবগুলো আপাতত ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আর সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক না থাকায় সার্জিক্যাল দ্রব্যাদি, ওষুধ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা হয়নি। তাই চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দকৃত অর্থের সবটা ব্যবহার করা যায়নি। খাবারের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫০ শয্যার রোগীর বিপরীতে। তাই সেটাও অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।’ সবগুলো শয্যা চালু ও শূন্য পদগুলোতে চিকিৎসক নিয়োগ করা গেলে হাসপাতালের সার্বিক চিকিৎসা সেবার মান আরও বাড়বে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতাল ॥ ১৯৯০ সালে পুরান ঢাকার লালবাগের ৪/১ গৌর সুন্দর লেনে ১০০ শয্যার এ হাসপাতাল চালু করা হয়। পরে ১৯৯৯ সালে ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ হাসপাতালের চারতলা ভবনের উদ্বোধন করেন। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে নিচতলা ও তৃতীয় তলায় মেডিসিন ও ডায়রিয়া বিভাগের অধীন চারটি ইউনিটে ৬০টি শয্যা চালু রয়েছে। সার্জারি চিকিৎসক না থাকায় দ্বিতীয় তলার ৪০ শয্যার সার্জারি ওয়ার্ডটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। আবাসিক চিকিৎসকরা থাকেন চতুর্থ তলায়। প্রয়োজনের তুলনায় অনুমোদিত চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। অনুমোদিত মাত্র ২২টি পদের বিপরীতে এখানে চিকিৎসক আছেন ১৬ জন। তবে গুরুত্বপূর্ণ পেডিয়াট্রিক বিভাগ, অ্যানেসথেসিয়া, রেডিওলজি ও প্যাথলজি বিভাগে কোনো কনসালট্যান্ট নেই। প্রেষণে থাকা চিকিৎসকরা বদলি হয়ে যাওয়ায় এ পদগুলো কয়েক বছর ধরে শূন্য রয়েছে। দু’টি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও সার্জনের অভাবে সেগুলো বন্ধ রয়েছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রেস্টফিডিং বিভাগ। ৩৯ জন নার্স স্টাফের মধ্যে আছেন মাত্র ২২ জন। ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের ২২টি পদের ১৩টিই ফাঁকা। টেকনিশিয়ানের অভাবে প্রয়োজনীয় ল্যাব টেস্টের সুযোগ নেই। ফলে অল্প খরচে অন্তঃবিভাগের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরিসংখ্যানেও ফুটে উঠে সে চিত্র। ২০১২ সালে এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ১৭০ জন। পরের দুই বছরে নতুন রোগীর সংখ্যা কমেছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে এ সংখ্যা যথাক্রমে ২ হাজার ৬৭৯ এবং ২ হাজার ৮৯৩ জন। রবিবার নিউট্রিশান ইউনিটে ভর্তি নয় মাসের শিশু সাবিতের মা লালবাগের বাসিন্দা নাঈমা আক্তার জানান, টেকনিশিয়ান না থাকায় অল্প কিছু ছাড়া সব টেস্টই বাইরে থেকে করে আনতে হয়। যা অনেক গরিব রোগীর পক্ষে অসম্ভব। এছাড়া সব ওষুধ বিনামূল্যে না পাওয়া, খাবারের নিম্নমান ও সেবার কাক্সিক্ষত মান না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে রোগীর অভিভাবকদের। একই দিন লালবাগের আরেক গৃহিণী সাবিনা ইয়াসমীন পা-ভাঙা পাঁচ বছর বয়সী শিশু সন্তান রাফিকে নিয়ে হাসপাতালে আসলে শিশুটিকে জরুরীভাবে অপারেশন করতে হবে জানিয়ে তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। গত কয়েক দিনে গুরুতর অসুস্থ আরও কয়েকটি শিশুকে এভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর ভিড় দেখা গেছে। তাদের প্রায় সবাই গরিব ও ছিন্নমূল মানুষের শিশু সন্তান। এ হাসপাতাল তাদের একমাত্র ভরসাকেন্দ্র। ২০১২ সালে বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৬ হাজার ৯২৪ জন। পরের দুই বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রোগীর এ সংখ্যা যথাক্রমে ৭২ হাজার ৬৭৩ ও ৭২ হাজার ২০১ জন। যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় এই হাসপাতালেও ওষুধ, সার্জিক্যাল দ্রব্যাদি ও রোগীর খাদ্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমেছে। গত অর্থবছরে ৮০ লাখ টাকা থাকলেও চলতি অর্থবছরে ওষুধের জন্য বরাদ্দ ৫০ লাখ টাকা। সার্জিক্যাল দ্রব্যাদি কেনার জন্য গতবার বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ টাকা (চলতি বছর মাত্র ১০ লাখ)। আর খাবারের বরাদ্দ গতবারের চেয়ে অর্ধেক কমিয়ে ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ মোশারফ হোসেন সংবাদপত্রে উদ্ধৃত হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নাজিরাবাজার মাতৃসদন কেন্দ্র ॥ ডিএসসিসি পরিচালিত একমাত্র মাতৃসদন কেন্দ্র এটি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে কেন্দ্রটি নগরবাসী মায়েদের কাক্সিক্ষত সেবা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ ডিএসসিসির চেয়ে কম বাজেট নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) পরিচালিত শুধু মাতৃসদন কেন্দ্রের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে একটি মাতৃসদন কেন্দ্রই ১০০ শয্যা বিশিষ্ট। কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ২০০১ সাল থেকে চালু হওয়া এ মাতৃসদন কেন্দ্রে ৩১টি শয্যা থাকলেও রোগীর অভাবে এসবের অধিকাংশই অব্যবহৃত। কেন্দ্রটি মূলত বহির্বিভাগের সেবা নির্ভর। ছয়তলার এ হাসপাতালটিতে নেই লিফট সুবিধা। রোগী না থাকায় পঞ্চম তলার ১৬ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল ওয়ার্ডটি ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোর রুম হিসেবে। ষষ্ঠ তলা আবাসিক চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য বরাদ্দ। তবে বরাদ্দ থাকলেও হাসপাতালের সাতজন নার্স রুম বুঝে পাননি। ডিউটি রুমে গাদাগাদি করে থাকেন তারা। সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ৪র্থ তলায় ১২ শয্যার ওয়ার্ডে রোগী আছেন মাত্র ২ জন। বহির্বিভাগেও রোগীর সংখ্যা কম। জানা গেছে, হাসপাতালে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ আছে মাত্র ১০টি। এর মধ্যে ছয়টিই শূন্য। প্রেষণে আসা দুইজন চিকিৎসক শিক্ষা ছুটিতে আছেন। বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র চারজন। অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান) মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সময় এ্যানেসথেসিস্টের উপস্থিতি অপরিহার্য। অথচ এ্যানেসথেসিয়া বিভাগের তিনটি পদই পাঁচ বছর ধরে শূন্য পড়ে আছে। বাইরের এ্যানেসথেসিস্টের এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বা ডেকে এনে অস্ত্রোপচার করানো হয়। তবে ইমার্জেন্সি রোগীর ক্ষেত্রে তা সবসময় সম্ভব হয় না। কেন্দ্রে উন্নতমানের কোনো আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন নেই। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের গাইনি পরামর্শক কাম প্রশাসক ডা. শাবীন আফরিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘স্থায়ী এ্যানেসথেটিস্ট ছাড়া আসলে কোন মাতৃসদন কেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ ধরনের কেন্দ্রে মায়ের পাশাপাশি শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকা জরুরী। কিন্তু এখানে বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসকের কোনো পদ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সীমিত জনবল নিয়ে ডিএসসিসি তার নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতার পরও চিকিৎসা সেবা বাড়াতে সম্প্রতি ডিএসসিসি অন্তর্গত দুটি হাসপাতাল ও ১টি মাতৃসদন কেন্দ্রে মোট ১৪ জন চিকিৎসক ও ২৬ জন নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল ও সদনটিতে আউটডোরে সেবা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া শিশু হাসপাতালের বর্তমান সেবার মান আগের যে কোনো সময়ে চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হাসপাতালগুলোতে ইনডোর সেবার মান বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। সেবা বাড়াতে আমাদের নতুন করে আরও চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মাসুদ আহসানের দাবি, জমি না পাওয়ায় মাতৃসদনের নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। তাছাড়া কর্পোরেশনের নিজস্ব যে জমি রয়েছে তাতে ভবিষ্যতে মাতৃসদন কেন্দ্র সম্প্রসারণের সুযোগ থাকবে না। ডিএনসিসির নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার কথা চিন্তা করে রাজউকের কাছে ৩০০ থেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমির আবেদন করা হয়েছে। তবে কবেনাগাদ হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা সীমাবদ্ধতায়ও কাজ করে যাচ্ছি।
×