ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারের কৃষিবান্ধব পদক্ষেপের প্রভাব;###;উপকরণের সহজলভ্যতায় বেড়েছে আবাদি জমিতে চাষের পরিমাণ;###;বিদ্যুতে সমস্যা না থাকায় সেচ সুবিধা বেড়েছে;###;পোকা-মাকড়ে ফসল আক্রান্তের খবর নেই;###;মধ্যস্বত্বভোগী প্রথা বিলোপ চায় কৃষকরা

সব রকম কৃষিপণ্যের আবাদ ॥ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫

সব রকম কৃষিপণ্যের আবাদ ॥ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ অনুকূল পরিবেশের কারণে এ বছর সব ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান সরকারের নেয়া কৃষিবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রভাব মাঠ পর্যায়ে পড়তে শুরু করেছে। বিদ্যুত বিঘ্নের সমস্যা না থাকায় সেচ ব্যবস্থা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে সাফল্যমণ্ডিত। সরকারী পদক্ষেপের সফলতা এখন কৃষকের মাঠে মাঠে। ফলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ফসল আবাদের পরিমাণ বেশি। গম, শীতকালীন ভুট্টা, আলু, মিষ্টি আলু, ছোলা, খেসারি ডাল, মসুর ডাল, সরিষাসহ প্রায় সকল ধরনের ফসল উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ফসল আবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকেরা চাষাবাদে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার অধিক মনোযোগী। কষিবিদদের মতে, কৃষিপণ্য উৎপাদনের উপকরণসমূহ সহজলভ্য ও তুলনামূলকভাবে কৃষকের অনুকূলে থাকায় আবাদী জমি চাষের পরিমাণ ও ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, অনুকূল পরিবেশের কারণে ফসল উৎপাদন ও ফসল চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল পণ্যের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট পণ্যের উৎপাদন অন্যান্য যে কোন বছরের তুলনায় বাড়বে। এখন পর্যন্ত পোকা-মাকড় কিংবা রোগ বালাইয়ে ফসল আক্রান্তের কোন খবর পাওয়া যায়নি। অদ্যাবধি প্রাপ্ত সকল খবরই ইতিবাচক। তাঁদের দাবি, একদিকে সারের দাম হ্রাস অন্যদিকে নানামুখী ইতিবাচক প্রভাবের ফলে আবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে দেশে খুব শীঘ্রই কৃষি বিপ্লব ঘটবে। দেশের আনাচে কানাচের সকল কৃষকেরা এখন বোরো ধান রোপণ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের দম ফেলার ফুসরত নেই, সময় কাটাচ্ছেন মহাব্যস্ততায়। ডিসেম্বর মাস থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত চলে বোরো ধানের মৌসুম। জানা যায়, চলতি মৌসুমে সারা দেশে বীজতলা স্থাপন প্রায় শেষের দিকে। তবে, কোথাও কোথাও এখনও চলছে বীজতলা স্থাপন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে তিন লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দুই লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। আর বাকি এলাকায় এখনও বীজতলা স্থাপন চলছে। অন্যদিকে, সারা দেশে মোট ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নয় লাখ ২২ হাজার ১৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। হাওর অঞ্চলে বোরোর আবাদ প্রায় ৮০ ভাগ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অন্যান্য এলাকায় বোরো চাষের প্রক্রিয়া চলছে। খাল-বিল, নদ-নদী কিংবা ডিপ টিউবওয়েলের পানির সাহায্যে বোরো ধানের আবাদ সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকায় কোনরকম সমস্যা ছাড়াই চলছে সেচ কাজ। ফলে পুরোদমে এগিয়ে চলছে বোরো মৌসুমের আবাদ। একাধিক কৃষক চলতি বোরো মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন। তাদের অভিমত সঠিক পন্থায় সারের বিলি-বন্টনসহ সরকার পূর্বাকার সময়ের মতো আগাম সচেতন হলে দেশে কৃষি বিপ্লব বয়ে যেতে পারে। দেশ এখন কৃষি বিপ্লবের চূড়ান্ত রেখায় অবস্থান করছে। বোরো মৌসুমের সময় কৃষি ঋণের দিকেও সরকারের অধিক মনোনিবেশ দাবি করেন তাঁরা। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণ জমিতে গমের বপন সম্পন্ন হয়েছে। কৃষিবিদদের ধারণামতে, অনুকূল পরিবেশের কারণে এ বছর গমের উৎপাদন বাড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, সারা দেশে চার লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মোট চার লাখ ৮১ হাজার হেক্টর পরিমাণ জমিতে গম বপন করা হয়। ৫১ হাজার হেক্টর অধিক জমিতে গম বপন হওয়ায় গমের উৎপাদন অন্যান্য যে কোন বছরের তুলনায় বাড়বে। কৃষিবিদদের ধারণামতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও আবাদের পরিমাণ বেশি হওয়ায় গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অনুকূল আবহাওয়াসহ বেশকিছু কারণে গত কয়েকদিন থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরিষার বাম্পার ফলনের আগাম খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে গ্রামের পর গ্রাম এখন চোখ ধাঁধানো হলুদে বিস্তীর্ণ সরিষার মাঠ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে সারাদেশে মোট পাঁচ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আবাদ হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার ৫ শত ৫৬ হেক্টর জমিতে। ধারণা করা হচ্ছে, ৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি সরিষা উৎপাদিত হবে। তবে, চলতি মৌসুমে শীতকালীন ভুট্টার আবাদ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। সারা দেশে শীতকালীন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় মোট তিন লাখ ৬ হাজার হেক্টর, এখন অবধি দুই লাখ ৩৩ হাজার ৭ শত হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দেশে আলু চাষের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে সারাদেশে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ধরা হলে প্রকৃতপক্ষে আলু চাষ হয়েছে চার লাখ ৭৬ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে। এই পরিমাণ জমিতে উৎপাদিত আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে দেশের আলুর চাহিদা মিটিয়ে চালের মতো আলুও বিদেশে রফতানি করা যাবে কৃষিবিদদের অভিমত। আলু চাষের আবাদী জমির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও মিষ্টি আলু চাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। সারাদেশে মিষ্টি আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৪ হাজার হেক্টর। চূড়ান্তভাবে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ হয়েছে। সূত্র জানায়, মিষ্টি আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ কম হওয়ায় এ বছর মিষ্টি আলুর উৎপাদন কমবে। সূত্রমতে; খেসারির ডাল, মসুর ডাল, শাক সবজিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণ জমিতে আবাদ হয়েছে। খেসারি ডাল চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকৃত জমির পরিমাণ দুই লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর নির্ধারিত হলেও বাস্তবে দুই লাখ ৯০ হাজার ২ শত ৫ হেক্টরেরও বেশি জমিতে তা চাষাবাদ করা হয়েছে। সারা দেশে মসুর ঢাল চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর ধরা হলেও দুই লাখ হেক্টর জমিতে গরিবের মাংসখ্যাত এ ডাল চাষাবাদ হয়েছে। চলতি মৌসুমে সারাদেশে মোট চার লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ২৪২ হেক্টর পরিমাণ বেশি জমিতে শাকসবজি চাষ হয়েছে। চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কৃষক জানায়; অনুকূল আবহাওয়াসহ সারের দাম হ্রাস, সেচের অনুকূল ব্যবস্থা, কৃষি প্রণোদনা এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণে কৃষকেরা এখন ফসল উৎপাদনে অধিক মনোযোগী। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কতৃক সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যায়ের কৃষকের খোঁজখবর রাখায় আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নানামুখী কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ বছর সকল কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়বে। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ছেটরাউতা গ্রামের কৃষক মোঃ আক্কাস জানান, আবহাওয়া ভাল থাকায় সব ফলনের লক্ষণ ভালর দিকে। এ বছর সরিষার আবাদ যে কোন বছরের তুলনায় বেশি। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার কৃষক ফরিদ প্রামাণিক জানান, শাকসবজিসহ পেঁয়াজের উৎপাদন এ বছর খুব ভাল। ধানের উৎপাদনও ভাল হবে বলে আশা করা যায়। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামের কৃষক সোহাগ ফকির জানান, আমাদের এই অঞ্চলে বোরো ধানের আবাদ পুরোদমে চলছে। ধান রোপণ শুরু হয়েছে। এই গ্রামের আশপাশে শীতকালীন ফসল তেমন ভাল হয় না। তবে গফরগাঁও চরে এবার সব ফসলের ফলনই ভাল। কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশী গ্রামের কৃষক হিমেল জানান, এই বছর হরশী গ্রামসহ আশপাশের সব এলাকায় আলুর চাষ খুব ভাল হয়েছে। তারপরও আলু উঠানোর আগ পর্যন্ত বিষয়টি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। পাতা কপি, ফুল কপি চাষে অন্যবারের চেয়ে আমরা লাভবান হয়েছি। পেঁয়াজের চাষও ভালর দিকে। ফসল উৎপাদন বাড়লেও মাঠ পর্যায়ের কৃষক অবহেলিত ও বঞ্চিত থেকে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী প্রথা বিলোপ করতে না পারলে দেশের কৃষক সমাজ তেমন উপকৃত হবে না। মহাজন প্রথার বিলোপ হলেও গরিব, হত-দরিদ্র কৃষককে এখন অপেক্ষাকৃত ধনীদের দ্বারস্থ হতে হয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গরিব কৃষক অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চাষাবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্রমবর্ধমান হারে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান আরও বৃদ্ধি পাবে। একাধিক কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেড়ে গেলে দেশের কৃষক সমাজের জীবনযাত্রায় বহুমুখী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবাদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্যে তা একটি সুখবর। কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে আবাদ হওয়ায় উৎপাদন বাড়বে। ফলে খাদ্যের পণ্য মূল্য কমবে। কৃষিপণ্যের মূল্য ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে তা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। দেশে মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে অনেক কমে এসেছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।
×