ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৫১ জন ॥ গত কয়েকদিনে মারা গেছেন ৫ ॥ বারো জন আশঙ্কাজনক

বার্ন ইউনিটের অপর নাম এখন মৃত্যুপুরী

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৫

বার্ন ইউনিটের অপর নাম এখন মৃত্যুপুরী

গাফফার খান চৌধুরী/শর্মী চক্রবর্তী ॥ বিএনপির ডাকা অবরোধে একসঙ্গে ২৮ জনকে পেট্রোলবোমা মেরে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যাচেষ্টার ঘটনা রীতিমতো ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। গত শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ওই ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনে একসঙ্গে এত মানুষকে দগ্ধ করে হত্যাচেষ্টার ঘটনা এই প্রথম। দগ্ধ অনেকের অবস্থাই গুরুতর। দগ্ধদের মৃত্যুযন্ত্রণা আর তাদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট যেন এখন মৃত্যুপুরী! আহতদের দেখতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি দগ্ধদের সান্ত¡না দেন। তাদের সরকারী খরচে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন তিনি। মন্ত্রী দগ্ধদের চিৎকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসের নেত্রী বলে অভিহিত করেন। শুক্রবারের রাতে দগ্ধদের একজন সালাহ উদ্দিন পলাশ (৩৬)। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দোতলায় বারান্দার একটি বিছানায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্বামীর পায়ের কাছে বসে আছেন পঁচিশ বছর বয়সী নাসরিন বেগম। কোলে সাড়ে তিন বছরের শিশু ইভা। মা-মেয়ের চোখের জল একাকার হয়ে গেছে। কান্না আর ধরতে পারছেন না। আমাদের কি হবে? সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এই অবস্থা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এমন অবস্থা বার্ন ইউনিটজুড়েই। দগ্ধ আর স্বজনের কান্নায় সেখানকার আকাশবাতাস ভারি হয়ে আছে। যেন মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে বার্ন ইউনিট। দেশব্যাপী অবরোধে পেট্রোলবোমাবাজরা কেড়ে নিয়েছে বহু মায়ের আদরের সন্তান। আর দগ্ধ অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সবারই এক কথা, এর শেষ কোথায়? বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ শহীদুল ইসলাম (৪২)। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। বললেন, যে সময় আমার কাজ করার কথা, স্ত্রী-সন্ত্রানদের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানো কথা সেই সময় আমি হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। জানালেন, আমার বাড়ি ঢাকা জেলার দোহারের চরশীগ্রামে। নারায়ণগঞ্জের ভুলতা এলাকার রবিন টেক্স নামের একটি বায়িং হাউসে চাকরি করি। দুই ছেলের জনক। গত শুক্রবার রাতে গুলিস্তান থেকে গ্লোরি পরিবহনের ওই যাত্রীবাহী বাসে কর্মস্থল ভুলতায় যাচ্ছিলাম। রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাড়িটি যাত্রাবাড়ি থানাধীন মাতুয়াইল কাঠেরপুল এলাকায় পৌঁছে। বাসটি যথেষ্ট গতিতেই চলছিল। চোখের পলকে একটি আগুনের ছোট কু-লী রাস্তার বাম দিকের একটি গলি থেকে ছুটে বাসের পেছনের দিকে আসতে দেখা যায়। সেটি বাসের পেছনে লেগে আগুন ধরে যায়। চালক আরও দ্রুত বাস টান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বড় আকারের আগুনের কু-লী জানালার কাঁচ ভেঙ্গে বাসের ভেতরে পড়ে। বড় কাঁচের বোতলে তৈরি পেট্রোলবোমাটি পড়েই ভেঙ্গে যায়। ছড়িয়ে পড়া পেট্রোলে চোখের পলকে পুরো বাসে আগুন ধরে যায়। কারো নামার কোন সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই হুড়োহুড়ি করে বাস থেকে নামতে নামতেই দগ্ধ হয়ে যাই। যারা পেছনের দিকে ছিলেন তাদের নামতে স্বাভাবিক কারণেই দেরি হচ্ছিল। তারা নামতে পারছিলেন না। যে যার যার মতো জানালা ভেঙ্গে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখন বাসজুড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় সবাই গগনবিদারী আর্তনাদ করছিলেন। পরে স্থানীয় জনতা আর ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনির্বাপন করে। তাদের দ্রুত হাসপাতালে আনা হয়। তিনি জানতে চেয়েছেন, তার দোষ কি? এদেশের নাগরিক হওয়াই কি তার জন্য দোষের? এর শেষ কোথায়? এমন শত আর্তনাদ বার্ন ইউনিটের আকাশে-বাতাসে। গুমরে কাঁদছেন দগ্ধ আর তাদের স্বজনরা। দগ্ধ রূপগঞ্জের রবি গার্মেন্টসের ইঞ্জিনিয়ার আল আমিন। ছেলের বিছানার পাশেই বিলাপ করে কাঁদছিলেন মা রহিমা বেগম। তিনি বলেন, আল আমিন মাত্র দশ দিন আকিব খান নামের পুত্রের পিতা হয়। এখনও সন্তানের মুখে বাবা ডাকই শুনতে পায়নি। এই শিশুকে তুমি এতিম করো না আল্লাহ! মায়ের প্রার্থনা তুমি শুনো। ছেলেটাকে তুমি আমার বুকে ফিরাই দাও। এই ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নাই। বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন রহিমা বেগম। জ্ঞান ফিরলেই আবার সেই একই বিলাপ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে যাত্রাবাড়ির ঘটনায় দগ্ধরা হচ্ছেনÑ জয়নাল আবেদীন, ইসতিয়াক, মোঃ বাবর, সালাউদ্দিন পলাশ, সালমান, নাজমুল হোসেন, মোঃ শরীফ, মোঃ রাশেদ, শাহিদা আক্তার, তার স্বামী ইয়াসির আরাফাত, সালাউদ্দিন, মোশারফ হোসেন, মোঃ হৃদয়, ওসমান গনি, মোহাম্মদ খোকন, মোঃ মোমেন, মোঃ হারিছ, নূর আলম, মোঃ ফারুক হোসেন, মোঃ সুমন, মোঃ রুবেল, আবুল হোসেন, শাজাহান সর্দার, মোজাফ্ফর মোল্লা, জাবেদ আলী, শহীদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম ও তানভীর। দগ্ধদের মধ্যে নয় জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্য ১৯ জনের শরীরের ২০ থেকে ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। শনিবার সকালে দগ্ধদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে হাজির হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি ঘুরে ঘুরে দগ্ধদের দেখেন। তাদের কথাও শোনেন এবং সার্বিক খোঁজখবর নেন। মন্ত্রী দগ্ধ আর তাদের স্বজনের যন্ত্রণায় চিৎকারে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সরকারী খরচে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের নির্দেশ দেন তিনি। পরে মন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বেগম জিয়া নিজেকে গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে দাবি করলেও বর্তমানে সন্ত্রাসের নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। দেশের জনগণ চায়, যারা সহিংসতা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। দগ্ধদের মাঝে নানা ধরনের ফল সরবরাহ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা হাজি সেলিম এমপি। বিকেলে বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডাঃ সামন্ত লাল সেন এক সাক্ষাতকারে জনকণ্ঠকে বলেন, যে হারে দগ্ধদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বার্ন ইউনিটকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। শীতকালে এমনিতেই দগ্ধ হওয়ার সংখ্যা বাড়ে। তারমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দগ্ধ হওয়ার সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। বার্ন ইউনিটে থাকা জনবল দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ৫১ জনের মধ্যে যাত্রাবাড়ির ৯ জনসহ ১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানান তিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ডাকা দেশব্যাপী টানা অবরোধ আর খ- খ- হরতালে দগ্ধ হয়ে গত শনিবার বিকেল পর্যন্ত ৮৩ জন ভর্তি হয়েছিলেন। গত কয়েক দিনে চিকিৎসাধীন ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা শেষে ২০ জনের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাদের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ৫১ জন চিকিৎসাধীন। এরমধ্যে ২৮ জনই গত শুক্রবারের রাতে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন। দগ্ধদের সরকারী খরচে সুচিকিৎসা চলছে বলে জনকণ্ঠকে জানান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডাঃ পার্থ শংকর পাল। এদিকে পেট্রোলবোমা হামলাকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিসহ গোয়েন্দারা। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ির ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
×