ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আইন কমিশনের সুপারিশ যাচাই-বাছাই করছে মন্ত্রণালয়

উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে শীঘ্রই নতুন আইন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৫

উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে শীঘ্রই নতুন আইন

বিকাশ দত্ত ॥ উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে শীঘ্রই নতুন নতুন আইন করা হচ্ছে। আইন কমিশন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি পদে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। আইন মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করে এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি চেষ্টা করছি, বিচারক নিয়োগের নীতিমালা নয় আইনই দিব। এর আগে বিচারপতি নিয়োগ দিতে কোন অসুবিধা নেই। নিয়োগ এখনও হতে পারে। বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে ৪ জন বিচারপতির পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে মামলা জট দূর করতে হলে আরও অধিক সংখ্যক বিচারপতি জরুরী ভিত্তিতে নিয়োগ করা দরকার। সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবীগণ এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বর্তমানে আপীল বিভাগে ৭ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৮৮ জন বিচারপতি রয়েছেন। চলতি বছরে আপীল বিভাগ থেকে একজন এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ৩ জন বিচারপতি অবসরে যাবেন। এছাড়া ৬ জন বিচারপতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ রয়েছেন। হাইকোর্টে ৮৮ জন বিচারপতির মধ্যে এখনও ২ জন বিচারপতিকে স্থায়ী করা হয়নি। সব মিলিয়ে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতির সঙ্কট রয়েছে। মামলা জট নিরসনে অতিসত্তর বিচারপতি নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে আইনজীবী মনে করেন। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইন কমিশনের সুপারিশটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিচারক নিয়োগের জন্য গঠন হতে পারে একটি কমিশন। এ কমিশনে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সরকার, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও সুশীল সমাজের একজন করে প্রতিনিধি রাখার বিধানটি সংযোজন করা হবে। এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশমালা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আইন কমিশন তাদের সুপারিশে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বিচারপতি পদে নিয়োগ চেয়েছে। বিচারপতি পদে নিয়োগে কমপক্ষে ৫০ বছর বয়স এবং অবসর গ্রহণের বয়স ৭৫ বছর নির্ধারণ করলে অভিজ্ঞ বিচারক দক্ষতার সঙ্গে অধিক সময় বিচারিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন। তবে এই বিধান কেবল নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে হবে। সংবিধানের ৯৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, বর্তমানে বিচারপতিদের বয়সসীমা সাতষট্টি বছর। এর আগে ১৯৮৬ সালের ১১ নবেম্বর সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ১৬ মে চতুর্দশ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ করা হয়। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, বিচারপতি নিয়োগে আমরা কোন নীতিমালা দিব না। আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের জন্য আইন দিব। সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমান আপীল বিভাগে ৪ জন বিচারপতির পদ শূন্য, অন্যদিকে দীর্ঘদিন হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হচ্ছে না। এতে করে মামলার জট বেড়ে যাচ্ছে। আইন করার পর নতুন বিচারপতি নিয়োগ করা হবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিতে কোন অসুবিধা নেই। নিয়োগ এখনও হতে পারে। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতায় রয়েছে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেবেন। সংবিধান অনুযায়ী আইন পেশায় ১০ বছর মেয়াদ বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পদে ১০ বছর অতিবাহিত হলেই হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। উচ্চ আদালতে কোন নীতিমালা বা আইন না থাকায় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। আইনজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশাজীবী থেকে বিচারপতি নিয়োগের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কথা উঠে। অবশেষে আইন কমিশন একটি সুপারিশ প্রণয়ন করেন। এর উপর ভিত্তি করেই বিচারপতি নিয়োগের আইন করা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সম্পাদক শ.ম. রেজাউল করিম ও মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ মেহেদী আপীল বিভাগে ও হাইকোর্ট বিভাগে জরুরী ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগের কথা বলেছেন। পাশাপাশি বিচারপতিদের জন্য আবাসন সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ বিচারপতিদের মর্যাদার বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী শ.ম. রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিচারক নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে বলা হয়েছে। দীর্ঘদিনে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদের অধীনে নেবার পরবর্তীতে বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত আইন করা যেমন ভাবে অনিবার্য, একই রূপে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। আইনমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন হবে এটা প্রত্যাশিত। তবে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত বা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। আমাদের দেশে বিচারপতিদের যে সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় তা পার্শ¦বর্তী অনেক দেশের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আবাসন ব্যবস্থা, যানবাহন, মর্যাদার ক্ষেত্রেও বিচারপতিদের এখনও প্রচুর সমস্যা রয়েছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠিত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবী বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহী হন না। তাই শক্তিশালী ও গুণগত মানে মর্যাদাপূর্ণ বিচার বিভাগ করতে হলে অবশ্যই বিচারক নিয়োগের আইনের পাশাপাশি তাদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার বিষয়টিও আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির আরেক সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ মেহেদী বলেছেন, সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের উভয় বিভাগেই বিচারপতি নিয়োগ করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা মামলা জট নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আশা করব মামলা জট নিরসনে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শীঘ্রই আরও নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। আইনমন্ত্রী বিচারপতি নিয়োগের জন্য যে আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন তার সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করছি। এদিকে বিচারক নিয়োগ, অপসারণ সংক্রান্ত দুটি আইনের কাজ করছে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। দুটি আইনের কার্যক্রম একসঙ্গে চললেও অপসারণের আইনটি প্রণয়নের কাজ আগেই সম্পন্ন করা হবে। জাতীয় সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে অপসারণ সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরেই নিয়োগ সংক্রান্ত আইনটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। আইন কমিশন ৬টি বিষয়ে সুপারিশে বলেছে, সংবিধানের ৯৫(২) (খ) এর অধীনে সুপ্রীমকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য অধস্তন আদালতে চাকরির অভিজ্ঞতা দশ বছর বিশেষভাবে বুঝতে ও গণনা করতে হবে। এই দশ বছর পুরাটাই বিচার কাজে নিয়োজিত অবস্থায় থাকতে হবে। কোন বিচার বিভাগীয় প্রশাসন যেমন আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোন সরকারী সংস্থায় কর্মের সময় গণনায় আনা যাবে না। উল্লেখিত দশ বছরের মধ্যে অবশ্যই ন্যূনতম তিন বছর জেলা জজ বা সম পর্যায়ের বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। অনুচ্ছেদ ৯৫(২)(ক) এর অধীন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী হিসেবে কর্মকালের দশ বছরও বিশেষভাবে বুঝতে হবে এবং পড়তে হবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা সফলভাবে পরিচালনাসহ তাকে নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে। যা প্রধান বিচারপতি ও তার সহবিচারপতিবৃন্দ নির্ধারণ করবেন। এছাড়া কমপক্ষে দুই বছর আপীল বিভাগে মামলা পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ নিছক আভিধানিক অর্থে নয়, বরং তা সাংবিধানিক ও বিচার বিভাগীয় ধ্যান-ধারণায় বিশেষ অর্থে পড়তে ও বুঝতে হবে। যার পলে পরামর্শ হয়ে উঠতে পারে অর্থবহ ও কার্যকর। এ জন্য রাষ্ট্রপতি কর্র্তৃক প্রধান বিচারপতির পরামর্শ চাওয়া এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রদান প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও লিখিতভাবে যাতে তার উপর সামাজিক পর্যবেক্ষণ সম্ভবপর হয়।
×