ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাহাত খান

জয়ী কিন্তু শেখ হাসিনাই

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

জয়ী কিন্তু শেখ হাসিনাই

রাজনীতিতে বহুদর্শী অনেক লোককে বলতে শুনতাম : বিএনপি সংলাপের দল নয়। ক্যান্টনমেন্টে ক্ষমতার রূঢ় ও নির্মম প্রভাব খাটিয়ে জন্ম নেয়া এই দলটি কোনদিনই সংলাপ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। বিএনপির জন্মদাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার রাজনীতিতে আস্থাবান ছিলেন। ইনডেমনিটি নামে দুনিয়ার জঘন্যতম ‘আইনের’ হোতা জেনারেল জিয়া ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাই বোধকরি বলেছিলেন : রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি আমি কঠিন করে তুলব। আমার কথা নয়, বহুদর্শী রাজনীতিক ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের কথা। তাঁরা শুধু বলতেন না, এখনও বলেন। গত ২৪ জানুয়ারি খালেদার ছেলের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে স্বেচ্ছা গৃহঅন্তরীণ খালেদা জিয়াকে তার পুত্র-শোকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। গিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হলো প্রবেশ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকার দরুন। প্রবেশ দরজার কাছে বা প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর ল্যান্ডিংয়ের কাছে রিসিভ করার জন্য বিএনপির কেউ ছিলেন না। বিএনপি মুখে সংলাপের কথা বলে, কিন্তু সংলাপে বা সমঝোতায় কখনও যে বিশ্বাসী নয়, এটা আবার বিএনপির ন্যক্কারজনক আচরণে প্রমাণিত হলো। টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যাচ্ছিল, বিএনপির বহু নেতা, বিএনপির শুভানুধ্যায়ী অনেকে প্রবেশ দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছেন, কেউবা বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমরা টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে পরিষ্কার দেখলাম। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর এসে গেছে, এটা জানামাত্র প্রবেশ দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে প্রবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন সাত-আট মিনিট। ঠিক এই সময় বাড়ির ভেতরে কয়েকজন সাংবাদিকের সামনে খালেদা জিয়ার জনৈক সহকারী খুব দুঃখ প্রকাশ করে বলতে শুরু করেন যে, পুত্র-শোকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ায় ডাক্তার তাঁকে (খালেদা জিয়াকে) ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন। তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমরা শিমুল বিশ্বাসের কথা বিশ্বাস করতে পারি। পুত্র-শোকে মাসনিকভাবে ভেঙ্গে গেলে ডাক্তার তাঁর রোগীকে ঘুমের ইনজেকশন দিতেই পারেন। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত নীচু মনের পরিচয় দিয়ে প্রবেশ দরজার মুখে বিএনপির লোকজন যে আটকে দিল, জেনে-বুঝে অপমান করল- এটাও না বোঝার কিছু নেই। এক মা পুত্রহারা আরেক মাকে দেখতে গিয়েছিলেন এটাই ঠিক। এখানে দৃশ্যত রাজনীতি কিছু ছিল না। তবে দেখতে যাওয়া মা যেহেতু দেশের প্রধানমন্ত্রী আর পুত্রহারা মা যেহেতু বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেত্রী- সংলাপ চাইছেন, আন্দোলনেও নেমেছেন,- সেহেতু আমরা মনে করি বিএনপির প- করে দেয়া এই মানবিক সাক্ষাতকারটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমাধানের একটি রুপোলি রেখা হয়ে দেখা দিতে পারত। পুত্র-শোকে কাতর মা’র সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলা ঔচিত্যের পরিপন্থী। সেরকম কিছু আশা করার কোন কারণ নেই। তবে মানবিক একটি সাক্ষাত অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর ক্ষেত্রে সহায়তা যে করত, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিহাসে লেখা সত্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বিএনপি ষড়যন্ত্র, হত্যাকা- ও সন্ত্রাস ছাড়া আর কোন কিছুতে বিশ্বাসী নয়। রাজনৈতিক সংলাপে তো নয়ই। কোনকালে ছিল না। এখনও নয়। তাই যদি না হবে তাহলে ৫ জানুয়ারির মাস দেড়েক আগে হাসিনা তো সংলাপের সূচনা করতে চেয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে বসে। নির্বাচনী সরকার হিসেবে সর্বদলীয় সরকার গঠনে শেখ হাসিনা ও তাঁর নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকারের যে কোন আপত্তি ছিল না, এটা তো ১৪ দলীয় সরকার প্রকাশ্যেই বলাবলি করেছিল। শেখ হাসিনা সম্ভাব্য নির্বাচনী সরকারে হোম মিনিস্ট্রি পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন বিএনপিকে। ডক্টর কামাল হোসেন, টিআইবি বিভিন্ন মানবাধিকার কমিশন, ফজলে হাসান আবেদ, মুহম্মদ ইউনূসÑ আপনাদের কি মনে পড়ে? কিন্তু শেখ হাসিনার দেয়া দু’জনের একান্ত সংলাপের প্রস্তাব শুনে একাত্তরের ৯ মাস ঢাকার পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টের নন্দিত নরকের সুখী বাসিন্দা খালেদা জিয়া সম্ভাব্য সংলাপের মাথায় লাথি মেরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতা ত্যাগের আল্টিমেটাল দিয়েছিলেন ১৪ দলীয় সরকারকে। একেই বোধকরি বলে দিল হ্যায় পাকিস্তানী। মেজাজও। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ বহুবার বিনীতভাবে বিএনপির প্রতি সংলাপের প্রস্তাব রেখেছেন। এও বলেছেন, দু’পক্ষ বসলে কিছু না কিছু একটা সমাধান অবশ্যই বার হয়ে আসবে। কিন্তু বিএনপি এই ধরনের রাজনৈতিক সংলাপের প্রস্তাবের কোনদিন একটা জবাবও দেয়নি! পার্লামেন্টে মাত্র ৩০-৩১টা আসনের অধিকারী হয়েও অত্যন্ত অগণতান্ত্রিকভাবে পরিহাসের সঙ্গে বিএনপি বলেছে, আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হোক,- নির্বাচনে যাবে কি যাবে না সেটা বিএনপি পরে বিবেচনা করবে। পার্লামেন্টে ক্ষীণ সংখ্যালঘুর এই অহঙ্কারী আচরণ কেন? তারা যাদের নিয়ে জোট পাকিয়েছে তারা তো দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও তেমন সমর্থন করে না। জামায়াত তো করেই না। ইদানীং এই দলগুলো আন্দোলনের নামে পেট্রোলবোমার রাজনীতি শুরু করেছে। ক্ষমতায় গেলে করে গ্রেনেড-রাজনীতি, ক্ষমতা হারালে করে পেট্রোল-রাজনীতি! গ্রেনেড-রাজনীতি আর পেট্রোল-রাজনীতির এই লোকজন সংলাপে বিশ্বাস করবে না, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী নিজে গেলেন সদ্য পুত্রহারা খালেদা জিয়াকে শোক ও সহানুভূতি জানাতে। বিএনপি এমনই অরাজনৈতিক স্বভাবের একটি দলে পরিণত হয়েছে যারা রাজনৈতিক মানবিকতা কোনটাই মানে না! জামায়াতের টাকা ও পরামর্শে চলা দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, খালেদার জ্যেষ্ঠ পুত্র লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমান আবার বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তাঁর গবেষণায় (!) নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু নন, পাকবন্ধু। তারপরও দালাল আঁতেলরা আর দুটি চরম অহঙ্কারী হয়ে ওঠা দৈনিক পত্রিকা সংলাপ না দেয়ার জন্য দোষারোপ করে আওয়ামী লীগকে! ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বেশ আগে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল বিএনপিকে বারবার সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছিল,- এটা ভুলে যাওয়ার ভান করা অপরাধতুল্য বলে মনে করি। সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচন করার আন্তরিকতা ও সাহস আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের ছিল। বিএনপি এবং বাংলাদেশ-বিরোধী জামায়াতে ইসলামীই সংলাপ, নির্বাচন ইত্যাকার গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বিশ্বাসী নয়। সে কারণেই সম্ভবত নিরীহ মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে দগ্ধ করাকে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বলতে লজ্জা পায় না ওরা। বিএনপি-জামায়াত তাদের ছেলেরা গ্রেফতার হলে অবরোধ তো আছেই, তার ওপর হরতাল দিতে দ্বিধা করে না! ধিক এই সন্ত্রাসরূপী রাজনীতির! এক মায়ের পুত্র-শোকে ২০টা দলসহ অনেকে হাহাকার করে ওঠে। সেটা অবশ্য কোন অন্যায় নয়। বরং মানবিকতার প্রশ্নে সেটাই মানুষের স্বাভাবিক ও সঙ্গত আচরণ বলে ধরে নেয়া উচিত! কিন্তু পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে গত কয়েকদিনে প্রায় অর্ধশত লোক যে মারা গেল, কত মা যে পুত্রহারা হলো, কত বধূ যে স্বামীহারা হলো, কত পরিবার যে ছারখার হয়ে গেলÑ তাদের জন্য ‘জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সংগ্রামে রত দলগুলোর একমাত্র দায়িত্ব বুঝি আরও পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ মারা? দালাল আঁতেলরা কি বলেন? অবশ্য চোখের মাথা খেয়ে দু’কান কেটে কার্যত যারা জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দলে গোপনে নাম লিখিয়েছে, নানা কায়দায় সন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন যুগিয়ে চলেছে,- তাদের কথা ভিন্ন! তাদের কথা ভেবে সময় নষ্ট করেও লাভ নেই। আমরা শুধু বলি গ্রেনেড ও পেট্রোল সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিরীহ, অসহায়, রাজনীতি-নিরপেক্ষ দেশবাসীকে বাঁচানো সরকারের দায়িত্ব। আর জনগণের উচিত পেট্রোলবোমাবাজদের দমনে সরকারকে সাহায্য করা। খালেদা জিয়া তাঁর পুত্র, নাড়ী-ছিঁড়া ধনকে হারিয়েছেন। নিজের দুঃখ আর ব্যথা-বেদনা দিয়ে তিনি যদি সন্ত্রাসকবলিত পুত্রহারা মা, স্বামীহারা বধূ কিংবা ভাইহারা ভাইয়ের দুঃখ আর ব্যথা-বেদনা বুঝতে না পারেন তাহলে সেটা হবে ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধ। খালেদাকে তাঁর পুত্র-শোকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,- খালেদার অফিসে। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান বা আপ্যায়ন করা দূরে থাক, অফিসের প্রবেশ দরজা বন্ধ করে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিহত করেছেন। অপমান করেছেন। চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। জয়ী কিন্তু শেখ হাসিনাই। দেশবাসীর কাছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে। একাÑ মানবিকতা, দূরদর্শিতা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
×