ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬ মাসে ১৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে

রহিম শেখ ॥ অবরোধ-হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো আমানতে সুদহার কমালেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে আগের মতো সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ছে বলে তাঁরা মনে করছেন। এছাড়া বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের জাল-জালিয়াতির ঘটনায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি ঝুঁকিহীন এবং বেশি মুনাফার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ীÑ চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১৩ হাজার ১৩৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। চলিত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৭৫২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ হাজার ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে ছয় মাসে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৩৭৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ৬ হাজার ২৩৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৪ হাজার ৫৭২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক মাস হিসেবে ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ১ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগের মাস নবেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১ হাজার ৪৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অক্টোবরে এসেছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে আসে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এত বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। আগস্ট মাসেও এক লাফে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ গিয়ে উঠে দুই হাজার ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আসে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ মাস জুনে নিট বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, মে মাসে এক হাজার ২৮৪ কোটি , এপ্রিলে এক হাজার ২৭৩ কোটি, মার্চে আসে ১ হাজার ২১৫ কোটি ৩৫৬ লাখ, ফেব্রুয়ারি মাসে ১ হাজার ২৬২ কোটি ১৭ লাখ, জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি ছিল ১ হাজার ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আকর্ষণীয় মুনাফা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অবরোধ-হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে। মূলত কোন ধরনের ঝুঁকি না থাকায় এবং বেশি লাভের জন্য সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটা ভাল সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগ তাঁরা নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বেশি এসেছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়। গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, অর্থবছরের শুরুর দিন ১ জুলাই থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে এ সময়ে সরকার ৯ হাজার ১৪১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিশোধ করেছে ৯ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ফলে নিট ঋণ ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে আলোচ্য সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ ছিল ৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। মূলত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বাড়ার ফলে এমনটি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ভাল থাকায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সাময়িকভাবে সরকারের ঋণ কমেছে। তবে বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তখন ঋণের চাপ বাড়বে। এবারের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী এমনটি বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন প্রচুর তারল্য রয়েছে। এ সময়ে ঋণ নিলে ব্যাংকের ওপর কোন চাপ তৈরি হবে না, বরং উপকৃত হবে। জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সুদের হার কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার। পরিবার, পেনশনার, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর ও পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করমুক্ত রেখেছে সরকার। বর্তমানে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে।
×