ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনবরত কামানের গোলায় কেঁপে উঠল শান্ত সাগর

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

অনবরত কামানের গোলায় কেঁপে উঠল শান্ত সাগর

ফিরোজ মান্না, যুদ্ধ জাহাজ সমুদ্র জয় থেকে ॥ সমুদ্র যাত্রাটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি’ উপন্যাসের ৮৪ বছর বয়স্ক সান্টিয়াগোর মতো ছিল না। এই যাত্রাটা ছিল গোলাবারুদ ভরা রণতরী নিয়ে। শত্রু পক্ষকে পরাজিত করার জন্য বঙ্গোপসাগরের ৬০ নটিক্যাল মাইল গভীরে ‘সমুদ্র জয়’ নামের রণতরী চলছে তো চলছেই। আর এই রণতরীকে ঘিরে আরও ১০ থেকে ১২টি রণতরী শত্রু মোকাবেলায় মিসাইল, কামানসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্রগ্রামের পতেঙ্গা বোট ক্লাব থেকে সকাল ৭টায় শুরু করল যুদ্ধযাত্রা। সান্টিয়াগো যদিও মাছ ধরতে সেদিন তার ১৩ বছরের বন্ধু মার্লিনকে তীরে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার ঘটনাটা পুরো উল্টো হয়েই গেছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ যুদ্ধের দৃশ্য দেখতে সমুদ্রে গিয়েছিলেন। যদিও যুদ্ধটা ছিল মিছেমিছি। তবুও মনে হয়েছে যেন কোন শত্রু পক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল আঘাত হানছে। বিকট শব্দে গভীর সাগরের পানি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। অনবরত কামানের গোলা ছুড়ছে নৌবাহিনীর সদস্যরা। টানা ১৬ দিনের মহড়া শেষে মঙ্গলবার সমুদ্র জয়ের চূড়ান্ত পর্বে শান্ত সাগর নৌবাহিনীর গোলায় বার বার কেঁপে উঠছে। যুদ্ধ শেষে ‘সমুদ্র জয়’ থেকে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, চীনের সঙ্গে দুটি সাবমেরিন কেনার চুক্তি হয়েছে। সাবমেরিনগুলো গ্রহণ করতে নৌবাহিনীর প্রথম দল চীনে প্রশিক্ষণরত রয়েছে। আমার বিশ^াস আগামী ২০১৬ সালের মধ্যে সাবমেরিনগুলো নৌবহরে যুক্ত হয়ে বাহিনীর সক্ষমতা বহুগুণ বাড়াবে, বাহিনী হবে ত্রিমাত্রিক। গভীরসমুদ্রে নৌবাহিনীর বার্ষিক মহড়া শেষে যুদ্ধ জাহাজ সমুদ্র জয় থেকে পোতাশ্রয়ে থাকা নাবিকদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে তিনি এ কথা বলেন। বাহিনীর বার্ষিক মহড়া প্রত্যক্ষ করতে চট্টগ্রাম থেকে একটি স্পিডবোটে করে সকাল সাড়ে ১০টার পর রাষ্ট্রপতি ‘সমুদ্র জয়’ যুদ্ধ জাহাজে পৌঁছান। নৌবাহিনীর সবচেয়ে বৃহৎ যুদ্ধ জাহাজ ‘সমুদ্র জয়’। জাহাজে এসে পৌঁছলে সমুদ্র জয়ের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ডব্লিউ এইচ কুতুব উদ্দিন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানান। নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব, সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া, সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ, রাষ্ট্রপতি দফতরের সচিব শেখ আলতাফ আলী, প্রতিরক্ষা সচিব হাবিবুল আউয়াল, বিএন ফ্লোটিলার কমডোর এম খালেদ ইকবাল, আইএসপিআর’র পরিচালক শাহীনুল ইসলামসহ সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। জাহাজে ওঠার পর পরই নৌবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পতেঙ্গা মোহনা থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর বার্ষিক মহড়া ‘এক্সারসাইজ সি থান্ডার-২০১৫’ শুরু হয় দুপুর সোয়া ১২টায়। টানা ১৬ দিনব্যাপী মহড়ার পর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পর্ব। দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, দেশ গড়ার কর্মকা- ছাড়াও সমুদ্রে চোরাচালান, অবৈধ মৎস্য আহরণ, জাটকা নিধন প্রতিরোধসহ উপকূল অঞ্চলে আশ্রয়ণ ও বনায়ন এবং প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা দুর্যোগে সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। পটুয়াখালীতে নতুন নৌঘাঁটি ‘বানৌজা শের-ই-বাংলা’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, যা সাবমেরিন ও এভিয়েশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা যে কোন সময়ের তুলনায় এই বাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছি। আপনারা আপনাদের কর্মতৎপরতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে নৌবাহিনীকে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহিনীতে পরিণত করবেÑ এ আহ্বান জানাই। দীর্ঘ ১৬ দিনব্যাপী এই বিশেষ সমুদ্র মহড়ার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অভিভূত হয়েছি। আমি আজ নৌবাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের মধ্যে যে পেশাদারিত্ব লক্ষ্য করেছি তা তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও কর্মস্পৃহা ও গভীর আত্মবিশ^াস এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমেরই প্রতিফলন। সেজন্য আমি নৌবাহিনী প্রধানসহ মহড়ায় অংশগ্রহণকারী সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত হওয়ার পরপরই ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর সমুদ্র জয়কে কমিশন করার সুযোগ হয়েছিল। আজ সেই জাহাজে করে নৌবাহিনীর সমুদ্র মহড়া অবলোকন করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করছি।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে প্রায় চার দশকের সমুদ্র বিরোধের অবসান হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী আমরা বঙ্গোপসাগরে সুবৃহৎ একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা এবং মহীসোপানে অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার লাভ করেছি। এ জয়ের পেছনে মূল অনুপ্রেরণা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি স্বাধীনতার সূচনা লগ্নেই তার দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭৪ সালে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার এ্যান্ড মেরিটাইম জোনস এ্যাক্ট প্রণয়ন করেছিলেন। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন করেছিলেন ৫টি সক্ষম রণতরী, যা ছিল সুসংগঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। সমুদ্র সীমা জয়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকায় আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশাল সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদ যেমন : প্রাকৃতিক গ্যাস, মৎস্য ও জৈব সম্পদ রক্ষার গুরুদায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ওপরই ন্যস্ত। দেশের ৯৫ ভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সি লাইনস অব কমিউকেশন রক্ষায় নৌবাহিনী সর্বদা থাকে সজাগ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি এ মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় আপনাদের কর্মপ্রয়াস জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। নৌবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকা-ের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিভিন্ন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ করে লেবাননে এবং মালিতে নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোটসমূহ প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে। গেল ডিসেম্বরে বন্ধুপ্রতিম দেশ মালদ্বীপে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট হলে খুব স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘সমুদ্র জয়’ সেদেশে ১০০ টন বিশুদ্ধ পানি ও ৫টি লবণমুক্তকরণ যন্ত্র সরবরাহ করে দেশের জন্য ব্যাপক সুনাম বয়ে এনেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী পেশাগত কর্মদক্ষতার মাধ্যমে বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ জাতীয় সমৃদ্ধির পথে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। আমি জেনে খুশি হয়েছি যে, সম্প্রতি খুলনা শিপইয়ার্ড হতে ৫টি পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণ করা হয়েছে এবং দুটি লার্জ পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তিতে আনন্দ শিপইয়ার্ডে একটি তেলবাহী জাহাজ এবং নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে দুটি ল্যান্ডিং ক্রাফট নির্মাণ করা হয়েছে। দেশে নির্মিত এ জাহাজসমূহ নৌবাহিনীর অপারেশনাল কর্মকা- এবং বার্ষিক মহড়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে- যা জেনে আমি খুশি হয়েছি। রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন চলছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা ফ্রিগেট ‘সমুদ্র জয়’ ছাড়াও গণচীন হতে দুটি ফ্রিগেট বানৌজা ‘আবু বকর’ ও ‘আলী হায়দার’ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। দুটি নতুন করভেট নির্মাণাধীন রয়েছে। পাশাপাশি নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে আধুনিক সমরাস্ত্র ও সরঞ্জামাদি দিয়ে সুসজ্জিত ও অধিক কর্মক্ষম করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। নৌবাহিনীতে দুটি উন্নতমানের মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট কিনে নেভাল এভিয়েশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নৌবাহিনীতে এক নতুনমাত্রা সংযোজিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৌবাহিনীর নেভাল কমান্ডো দল সোয়াডস গঠন করা হয়েছে। এদিকে, নৌবাহিনীর সাগরে টানা দুই ঘণ্টার যুদ্ধে শ^াসরুদ্ধকর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয় তখন সত্যিই এক মহাপ্রলয় ঘটার মতো সব কা- চলছিল।
×