ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতিতে মানবিক সৌজন্যও কি নির্বাসনে?

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

রাজনীতিতে মানবিক সৌজন্যও কি নির্বাসনে?

বিএনপি রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে পড়ছে। বিএনপির রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র, চক্রান্তই যে সারকথা তা বিগত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড এবং রাজনীতি-চর্চার স্বরূপ থেকেই জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মালয়েশিয়ায় জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠসন্তান আরাফাত রহমান কোকোর আকস্মিক মৃত্যুকে ঘিরে বেগম জিয়া ও তাঁর খয়ের খাঁবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে অসদাচরণ করলেন তা শিষ্টাচার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ছাড়া আর কী! একজন শোকার্ত মাতার প্রতি সমবেদনা জানাতে অপর একজন মাতা সহানুভূতির মন নিয়ে দেখা করতে গেলেন আর বিএনপি নেতৃবৃন্দ বড় বড় তালা ঝুলিয়ে রেখে গুলশানের বিএনপি কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখে দেশবাসীকে কী বোঝাতে চাইলেন? প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত বিএনপি নেত্রী বহাল তবিয়তে মওদুদ, মঈন খানগংদের সঙ্গে বাতচিত করেছেন অথচ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিএনপি নেতাদের আগেভাগেই প্রধানমন্ত্রীর সেখানে যাওয়ার বার্তা পৌঁছে দেয়ার পর দৃশ্যপট বদলে গেল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদিত হয়ে এবং গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনপূর্বক বেগম জিয়াকে লাল ফোনের মাধ্যমে ফোন করে তাঁকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের সে সময় বেগম জিয়া কী ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিলেন তা দেশবাসী জানে। ওই টেলি-সংলাপ যখন প্রকাশ করা হলো তখন বিএনপি নেত্রীর মুখোশ জনগণের চোখের সামনে হুট করে খুলে গেল। প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপি কার্যালয়ে গেলেন তখন বিশিষ্ট বিএনপি কর্তারা সেখানে থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে যেতে দেয়ার মতো সামান্য সৌজন্যবোধ যাঁরা দেখাতে পারেননি, তাদের মনের মধ্যে আসলে তাহলে কী আছে এটি একটি বড় প্রশ্নই বটে! সবকিছুকেই রাজনীতির মানদ-ে বিচার করতে গিয়ে জনগণের চোখে যে তাদের নিজেদের কপটতা ধরা পড়ে যাচ্ছে এই বোধ বা চেতনা তাদের আছে কি? বেশ ক’বছর আগে প্রখ্যাত কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ যখন সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন শিবিরের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে, তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে ওই হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেয়া হয়নি। তখনও তিনি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কোন সৌজন্য প্রদর্শনের তোয়াক্কা করেননি। আজও নিজ পুত্র-বিয়োগের পরও তা করলেন না। স্বল্পভাষী বেগম জিয়া সুযোগ পেলেই যে তাঁর শিক্ষার ধারালো ও অসংযত রূপ প্রকাশে পিছপা হন নাÑ এ কথাটি তিনি বার বার তাঁর বক্তব্যে প্রমাণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিএনপি নেত্রীর সমালোচনা করেন তখন সুশীল সমাজের কেউ কেউ শেখ হাসিনার শ্রাদ্ধ করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া যখন অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন তখন এসব সুশীলের মুখে রা পড়ে না, বরং তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে কূটযুক্তি উপস্থাপন করে বেগম জিয়ার অভব্যতাকেই ভব্যতা হিসেবে প্রমাণের জন্য প্রাণান্তকর কসরত করেন। কে না বোঝে যে, এসব ‘পেইড এজেন্ট’ দেশী-বিদেশী প্রভুদের মনোতুষ্টির মাধ্যমে এবং দেশে অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তৃতীয় শক্তির ক্ষমতারোহণের পথ পরিষ্কার করতে সচেষ্ট। বিএনপি কিংবা তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে পারলেই এদের কেউ জেনেভায়, কেউ হেগে, কেউবা ওয়াশিংটন-লন্ডনে বিভিন্ন বড় চাকরি জুটিয়ে বিদেশী প্রভুদের সেবা করে দেশ ও দেশের গরিব মানুষের ভাগ্য বিপর্যয়ে ভূমিকা রেখে নিজেদের আখের গোছাবেন। এরা বিবেকের তাড়নায় পরিচালিত হয় না; হয় নিছক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের তাড়নায়। ফলে ইদানীং সন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে আন্দোলন বলে চালিয়ে দিতে এদের বিবেকে এতটুকু বাধে না। এসব স্বার্থবাজ জনগণকে আইয়ুব খানের মতোই ভেড়া মনে করে, আর তাই নানা কূট-কৌশলে ও অপব্যাখ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করে রাখে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে গাঁটছড়া তা প্রকারান্তরে বিএনপিকে আরও কঠিন ডানপন্থী দলে পরিণত করেছে। এর মধ্যে যেসব বামপন্থী আছেন তারাও প্রকৃত প্রস্তাবে ডানঘেঁষা বাম। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শের কোন বালাই তো দলটির মধ্যে নেই। বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জনটি হচ্ছে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ। সেই মুক্তিযুদ্ধ এবং এর অভীষ্ট লক্ষ্যটিকে বানচাল করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানবাদী তথাকথিত মুসলিম ঘরানার একটি দেশে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে যাবতীয় ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, প্রতারণা ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে চলেছে এ দলটি। বিগত নির্বাচনটিকে বানচালের জন্য যে নারকীয় সন্ত্রাস বিএনপি উস্কে দিয়েছিল এবং বর্তমানে যে পৈশাচিক উন্মাদনায় ম্যাডাম জিয়া মেতে উঠেছেন তা জঘন্য পাপ-বিশেষ। এ কোন রাজনীতি নয়! জনগণের বিরুদ্ধে এ এক প্রকার যুদ্ধ। একাত্তরে এবং পরবর্তীতে জিয়া, বেগম জিয়া ও এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত, হেফাজত, হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি, বাংলা ভাই প্রভৃতির যে নারকীয় উল্লাস দেশবাসী দেখেছে তারই ধারাবাহিকতায় চলছে তাদের অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের আমলের এই উন্মত্ত আস্ফালন! পেট্রোলবোমায় অবোধ শিশু ও নিরীহ নারী-পুরুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে আর একে বিএনপি নেত্রী ও তাঁর স্যাঙাতরা শান্তিপূর্ণ অবরোধ-হরতাল ইত্যাদি নামে অভিহিত করে যে মিথ্যাচার করছেন তা রীতিমতো পাপÑ জঘন্য অপরাধ! তার তল্পিবাহক সুশীল বাটপাড়রা মানুষ হত্যার এই উলঙ্গ আয়োজনের নিন্দা করেন না বরং আত্মপ্রসাদ লাভ করেন এই ভেবে যে, সরকারকে বিপাকে ফেলা যাচ্ছে। এই বন্দী-বিবেক, গণশত্রু ও চিহ্নিত সুশীলদের ব্যাপারে এখনই দেশবাসীর সোচ্চার হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের যে বিরুদ্ধ-শক্তি বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়েছে তাদের জন্য আজ অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য তারা বেগম জিয়া এবং বিএনপির অন্যদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে অবলীলায়। তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ওই নেতারা তাদের প্রভুদের আশীর্বাদে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলেছেন তার বিনিময়ে ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির সেবা করা ছাড়া তাদের যে কোন গত্যন্তরই নেই! আজ জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ এবং জনদাবির কাছে নতিস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ¯œাত একটি দল গড়ে তোলার অভিপ্রায় বা ইচ্ছা বেগম জিয়া যদি মনের নিভৃতপল্লীতে পোষণও করেন, তথাপিও তাঁকে ওই প্রভুদের চাপেই সে ইচ্ছাকে মনের মধ্যে টুঁটি টিপে হত্যা করতে হবে। বেগম জিয়া ও তাঁর পুত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা ছাড়া কোন উপায়ই যে নেই। শারীরিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে আজ আইএসআই ও জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের তোষণ ও পোষণ করাই বিএনপি নেত্রী ও তারেকের বিধিলিপি! এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অভব্যতা প্রদর্শন করা এবং জনগণকে উপেক্ষা করা ভিন্ন কোন পথই খোলা নেই ওদের জন্য। আর এ কারণে ওদের প্রতি জনগণের করুণাই হয় মাত্র। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×