ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আরএম দেবনাথ

মধ্যবিত্ত ছাড়া মধ্যআয়ের দেশ কি সম্ভব?

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

মধ্যবিত্ত ছাড়া মধ্যআয়ের দেশ কি সম্ভব?

বারাক ওবামা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট। শক্তিশালী অনেক অর্থেই। সামরিক দিক থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকেও পিছিয়ে নয় আমেরিকা। একটা কাগজে দেখলাম, বিশ্বের সকল নোবেল বিজয়ীর আশি শতাংশের বসবাসই ঐ দেশে। আর্থিক সম্পদেও তাই। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনীদের দেশও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা আমেরিকার নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করতে অনেকেই কুণ্ঠিত, কিন্তু সেই দেশের ভিসার জন্য উদগ্রীব। তাই নয় কি? এহেন দেশের প্রেসিডেন্ট মাঝে-মধ্যেই প্রায় কমিউনিস্টদের মতো কথা বলেন। বেশ কিছুদিন আগে তিনি আমেরিকার ব্যাংক ও কোম্পানিগুলোর বড় কর্মকর্তাদের বোনাস না নিতে অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরা রাজি নন। তিনি হুমকি দিলেনÑ বোনাস আপনাদের অধিকার, রাষ্ট্রের ক্ষমতা আছে সর্বোচ্চ হারে কর বসাবার, আমি তাই করব। সবাই নরম হন। কিছুদিন আগে তিনি চীনে গিয়ে বললেন, রফতনির ওপর নির্ভরশীলতা কমান, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ করুন। বিশ্ব তাতে উপকৃত হবে, হবে নিজের দেশও। তিনি ধনীদের ওপর অধিকতর করারোপের পক্ষে বরাবর। এবার তিনি আরও খোলাখুলি বললেন চমৎকার একটা কথা। বললেন, ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন এ্যাড্রেস-২০১৫’তে বললেন মধ্যবিত্তের অর্থনীতির কথা। ভুটানের রাজা বললে কেউ তা গ্রাহ্য করত না। তিনি বরাবর বলেন ‘গ্রস ডমেস্টিক হ্যাপিনেসের’ কথা। অর্থাৎ ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ নয়, এমনকি নয় ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে’ পরিমাপিত উন্নয়নও (এইচডিআই)। উন্নয়ন দিয়ে কী হবে, যদি মানুষের মনে সুখ না থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে কী হবে যদি তার ফসল সবাই না পায়, সবাই যদি কম-বেশি তার ভাগ না পায়। ঠিক এ কথাই এবারকার ইউনিয়ন এ্যাড্রেসে বললেন শক্তিধর প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা যিনি ভারতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করে, বহু প্রটোকল ভাঙ্গার ইতিহাস সৃষ্টি করে মঙ্গলবার গেলেন সৌদি আরবে। ওবামা বলেন, সবারই ভাগ পাওয়া উচিত, একই নিয়মে সবার খেলা উচিত, সবারই দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা উচিত। যত বেশি মধ্যবিত্ত তত বেশি উন্নয়ন, ততবেশি আলোকিত দেশ। মধ্যবিত্ত পরিণত হবে, নতুন মধ্যবিত্ত সৃষ্টি হবে, আরেকটা শ্রেণী থাকবে যাদের বলা যায়, ‘এসপায়ারিং মিডিল ক্লাস।’ ওবামার ‘মধ্যবিত্তের অর্থনীতির’ সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি? আমরা তো এগিয়ে চলেছি দারুণ গতিতে। এ কথা অন্ধ অথবা পাগলও বলবে না বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে না। শুধু রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, কলকারখানা নয়, অর্থনীতির মৌলিক সূচকের হিসাবেই আমরা দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছি। এই গতি ত্বরান্বিত হয়েছে গত পাঁচ-ছয় বছরে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ। আট মাসের পণ্য আমদানির জন্য যা দরকার সেই পরিমাণ ডলার আছে আমাদের। যেখানে তিন মাসের সমপরিমাণ থাকলেই চলে। পোশাক রফতানি বাড়ছে। বৈদেশিক রেমিটেন্স সরকারীভাবেই মাসিক ১০ হাজার কোটি টাকা। অবিশ্বাস্যভাবে মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকার পরও মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের ঘরে। অবিরামভাবে ৬-সাড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শিক্ষিতের হার, মাতৃমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু, নিরাপদ জলপ্রাপ্তি, শিশুমৃত্যু হ্রাস ইত্যাদি নিরিখেও আমরা ঈর্ষণীয় ফল দেখাচ্ছি। তাহলে সমস্যা কোথায়? আমরা মধ্যআয়ের দেশ হতে চাই। মধ্যআয়ের দেশে মধ্যবিত্তের ভূমিকা কি হবে? মধ্যবিত্ত না থাকলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্ভব, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সম্ভব। প্রচলিত হিসাবে ধনী-গরিবের হিসাব এক সঙ্গে হয়। গরিবের হিসাব ওপরে ওঠে, ধনীর হিসাব নিচে নামে। কারণ এটা গড়ের হিসাব। এই হিসাবে আসল চিত্র ধরা পড়ে না। মাসে প্রায় ১০০ ডলার আয়ে দেশের সবচেয়ে ধনী লোকের হিসাবও আছে, দরিদ্রতম লোকের হিসাবও আছে। ‘ভাগের’ হিসাবে ধনীর ভাগ উৎকটভাবে বেশি, গরিবের খুবই কম। মানে সমাজে দারুণ বৈষম্য। অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্য, অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বৈষম্য। যেন সারাবিশ্বের বৈষম্যের একটা নির্ভুল চিত্র। ‘অক্ফাম’ কিছুদিন আগে বিশ্বের ধন-সম্পত্তির বৈষম্যের একটা চিত্র দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, বিশ্বের ৫০ শতাংশ লোকের যা সম্পদ তার সমান সম্পদ মাত্র ৮৫ ব্যক্তির। সারাবিশ্বের আয় যদি হয় ১০০ টাকা তাহলে ৪৮ টাকার মালিক এক শতাংশ লোক। বলা বাহুল্য, বাজার অর্থনীতির কল্যাণে এই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই। সেখানে কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা যা পান তার ছটাকও পান না সাধারণ কর্মী ও অফিসাররা। বলা বাহুল্য, একই চিত্র বাংলাদেশেও। অথচ প্রায় অর্থনীতিবিদই এখন বলছেন বৈষম্য উন্নয়নের বিপক্ষশক্তি। বৈষম্য মধ্যবিত্তবিরোধী। এমন এক সময় ছিল যখন বিলাত-আমেরিকার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতবিদরা বলতেন বৈষম্য দরকার। বৈষম্য দিয়ে ধনী লোক তৈরি করতে হবে। তারাই উন্নয়ন ঘটাবে। এই যুক্তি এখন চলে না। গণতন্ত্রের জামানা। শাসকদের সমাজের সকলকে নিয়ে চলতে হয়। সংখ্যাধিক্যের ভোটের দরকার হয়। ভোটার সন্তুষ্টি দরকার। অতএব, একনায়ক না হলে বৈষম্যের পক্ষে গান গাওয়া যায় না। এ কারণেই ওবামা বলছেন মধ্যবিত্তের কথা। মধ্যবিত্তের অর্থনীতির কথা। বাংলাদেশ আজ হোক, কাল হোক মধ্যআয়ের দেশ হবেই। ২০১২-১৩ অর্থবছরেই মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ছিল এক হাজার ৫৪ ডলার। এই মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশ হতে হলে আমাদের করণীয়ের তালিকা হবে দীর্ঘ। মধ্যআয়ের দেশের সংজ্ঞা আবার বিভিন্ন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব এক রকম। জাতিসংঘের হিসাব ভিন্ন রকমের। বিশ্বব্যাংক দুনিয়ার তাবত দেশগুলোকে ৪ ভাগে করে যথা : নিম্নআয়ের দেশ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চআয়ের দেশ। জাতিসংঘের মানদ- ভিন্ন। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানদ- ব্যবহার করে। তাদের শ্রেণী তিনটি : স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশ। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মানদ- ভিন্ন ভিন্ন, আবার দুটোর যে কোন একটির ভিত্তিতে মধ্যমআয়ের দেশ হতে হলে সংগ্রামটি আমাদের জন্য কঠিন, তবে অসম্ভব ব্যাপার নয়। আমার প্রশ্ন অর্জনের শক্তি নিয়ে নয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে অর্থনৈতিক মানদ-ই প্রধান। জাতিসংঘের মানদ-টি একটু ব্যাপক। তাদের হিসাবে তিন বছরের গড় আয় ধরা হয়। পরে হিসাব করা মানবসম্পদ সূচক যথা : পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্কুলশিক্ষা, শিক্ষার হার ইত্যাদি। সর্বশেষ হচ্ছে আর্থিক ভঙ্গুরতা। এর ব্যাপকতা বিশাল। যেভাবেই এগোনো হোক না কেন, আমার প্রশ্ন মধ্যবিত্তকে নিয়ে। তাকে সন্তুষ্ট না রেখে, তাকে বিলীন করে, তার অবদান খাটো করে কি মধ্যআয়ের দেশ হয়ে আমাদের কোন উপকার হবে? আমি মনে করি- না, তা হবে না। মধ্যবিত্ত শুধু রাজনীতিক ও সামাজিক ইতিহাসকেই সৃষ্টি করে না, তারা অর্থনীতিরও মেরুদ-। মধ্যবিত্তই বাজার। বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় তিন-চার কোটিই ‘মার্কেট।’ তারাই ক্রেতা, তারাই ভোক্তা। ফ্ল্যাট কেনা, জমি কেনা, বাড়ি করা, কাঁচামাল ভোগ করা, ভোগ্য পণ্য সেবা করা, বাড়ি কেনা ইত্যাদি সবই মধ্যবিত্তের বিষয়। মধ্যবিত্ত হোটেলে যায়, পর্যটক হিসেবে বেড়ায়, বাগানবাড়িতে যায়। নাটক-সিনেমায় যায়। ভাল পোশাক পরে, পিঠা না খেয়ে পিজা খায়। সেই মধ্যবিত্তকে বাদ দিয়ে মধ্যমআয়ের দেশ হলে কি লাভ? উদাহরণ দিই। রিয়েল এ্যাস্ট্রেটের বা বেসরকারী ব্যাংকে ৩৫-৪৫ বছরের যুবক-যুবতী যদি চাকরি হারায় তাহলে মধ্যবিত্ত গড়ে উঠবে কোত্থেকে? এই বয়সে মানুষ ছেলেমেয়েকে পড়ায়, একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করে। বছরে একবার-দু’বার বেড়াতে যায়। নতুন চাকরি নেই। পুরনোরা যদি চাকরি হারায় এবং রাষ্ট্রেরও যদি কোন সাহায্য প্রকল্প না থাকে তাহলে বাজার সৃষ্টি হবে কোত্থেকে? মধ্যবিত্ত যদি বাড়ি ভাড়া কুলোতে না পেরে পুরান ঢাকা থেকে মিরপুরের ঘিঞ্জিতে বসবাস করতে যায় তাহলে ‘বাজার’ হবে কোত্থেকে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বেতন যা বাড়ছে, আয় যা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি বাড়ছে সংসারের খরচ। রিক্সা ছেড়ে মধ্যবিত্ত বাসে উঠছে, চিনির ভোগ, দুধের ভোগ, মাছের ভোগ, মাংস ও ফলমূলের ভোগ মধ্যবিত্ত কমাচ্ছে। তারপর এক পর্যায়ে গিয়ে ছেলেমেয়ের কোচিং বন্ধ করছে। মধ্যবিত্ত সঙ্কুচিত হতে হতে ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। মধ্যবিত্ত চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে গ্রামের বাড়ির পৈত্রিক জমি বিক্রি করছে। ওষুধ কিনতে কিনতে, টেস্ট করাতে করাতে মধ্যবিত্ত ফতুর হচ্ছে। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করে ভূমিহীন হচ্ছে। বাড়ির ফ্যান বন্ধ রাখছে। যাদের গাড়ি ছিল তারা খরচ পোষাতে না পেরে ড্রাইভার বিদায় করছে। উদাহরণ আর বাড়াব না। মধ্যবিত্ত অবসরপ্রাপ্তদের সুদআয় প্রায় অর্ধেক হয়েছে। অথচ তার খরচ বেড়েই চলেছে। এটা মধ্যবিত্তের অর্থনীতির লক্ষণ নয়। আমরা উন্নতি করব, মধ্যআয়ের দেশ হব, হতে হতে এক সময় আমেরিকাকেও ধরে ফেলতে পারি। ইতোমধ্যে তৈরি হবে বৈষম্য, মধ্যবিত্ত খাদে পড়বে। তখন বলতে হবে মধ্যবিত্তকে বাঁচাও। এ কাজ না করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। অর্থনীতির ও উন্নয়নের ফসল ভাগ হওয়া দরকার। শত হোক মধ্যবিত্তকে বিলীন করে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি সম্ভব নয়। এ কাজে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে এটাই আশার কথা। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×