ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাখাইনদের তাঁতবস্ত্র

হরেক রঙের ফতুয়া লুঙ্গি, চাদর- উপকূলের ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

হরেক রঙের ফতুয়া লুঙ্গি, চাদর- উপকূলের ঐতিহ্য

শংকর লাল দাশ ॥ রাখাইনদের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য বহু পুরনো। নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই রাখাইনরা এক সময় তাঁত বস্ত্র বয়ন শুরু করেছিল। তারা তৈরি করত লুঙ্গি ও চাদরসহ আরও অনেক কিছু। কালের পরিক্রমায় এগুলো এখন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে সমাদর পেয়েছে পর্যটকদের কাছেও। পটুয়াখালী বা বরগুনা অঞ্চলের সাগর পাড়ে বেড়াতে এসে রাখাইন পল্লীগুলোতে যায়নি এমন পর্যটকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। রাখাইনরা ১৭৮৪ সালে আরাকান (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে এদেশে আসে। তাদের একটি গোষ্ঠী বসতি গড়ে তুলেছিল পটুয়াখালীর দুর্গম রাঙ্গাবালী এলাকায়। পরবর্তীতে তারা ছড়িয়ে পটুয়াখালী ও বরগুনার বিভিন্ন স্থানে। এ কারণে এখানে এলে রাখাইন সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ধারার দেখা মেলে। পাওয়া যায় তাদের তৈরি তাঁতের নানা পণ্য। রাখাইনদের তাঁতে বোনা লুঙ্গি আর চাদরের কদর দেশ কালের গ-ি ছাড়িয়ে গেছে। পর্যটকদের অনেকেই সবার আগে পছন্দ করেন রাখাইনদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠা এ দুটি পণ্য। এলাকার মানুষের কাছেও রাখাইন লুঙ্গি চাদরের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। উপকূল অঞ্চলের ঐতিহ্যের ইতিহাসে রাখাইনদের লুঙ্গি-চাদরের অবদান অনেকখানি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে পটুয়াখালী ও বরগুনার কয়েকশ’ তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। লুঙ্গি ও চাদর ছাড়াও ফতুয়া, হাফ শার্ট, ভ্যানিটিব্যাগ, বালিশের কাভার আছে তাদের পণ্য তালিকায়। এর মধ্যে লুঙ্গি ও চাদরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। চাদরের মধ্যে যেমন শীতে গায়ে দেয়া চাদর রয়েছে। তেমনি রয়েছে বিছানার চাদর। এর সুতা সংগ্রহ করা বাইরে থেকে। পর্যটকদের সুবিধার্থে কুয়াকাটায় এখন গড়ে তোলা হয়েছে রাখাইন মার্কেট। সেখানকার কয়েকটি স্টলে রাখাইনরা নিজেরাই নিজেদের পণ্য বেচাকেনা করে। পটুয়াখালীর মিস্ত্রিপাড়া, ছাতিয়ানপাড়া, মৌডুবি ও বরগুনার তালুকদার পাড়াসহ রাখাইন পল্লীগুলোতে ঢুকলেই কানে আসবে তাঁতের টুকটাক শব্দ। দেখা মিলবে রাখাইন নারীদের। কেউ ব্যস্ত সুতা ছাড়ানোর কাজে। কেউ রঙের কাজে। আবার কেউবা দুই হাতে সমানে ব্যস্ত তাঁতে। পুরুষদের তুলনায় নারীরাই এ পেশায় জড়িত। আকার ডিজাইন ও রংয়ের ওপর নির্ভর করে রাখাইনদের তৈরি পণ্যের দাম। শীতে গায়ে জড়ানো চাদর যেমন পাঁচশ’ টাকায় পাওয়া যাবে। আবার দুই হাজার টাকার বেশি দামের চাদরও রয়েছে। একইভাবে বিছানার চাদর কিংবা লুঙ্গির রয়েছে বিভিন্ন রকম দাম। নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানপাড়ার রাখাইন তরুণী নো মাও (২৮) জানালেন, ‘আমরা রাখাইনরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পোশাক হিসেবে লুঙ্গি ব্যবহার করি। কখনই বাইরের তৈরি লুঙ্গি ব্যবহার করি না। বাপ-দাদারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে তাঁতে লুঙ্গি বুনতেন। আমরা সে ঐতিহ্য ধরে রেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লুঙ্গি বা চাদরের দাম তুলনামূলক কিছু বেশি হলেও টেকে বেশিদিন। যে কারণে স্থানীয়রাও আমাদের লুঙ্গি ব্যাপক হারে কেনে।’ বরগুনার তালুকদার পাড়ার রাখাইন যুবক বাবু (২৪) জানান, গায়ে দেয়া একখানা চাদর বুনতে সময় লাগে কমপক্ষে দু’দিন। সুতা বা উল লাগে তিন-চারশ’ টাকার। তারা সেটি বিক্রি করেন ৫-৬শ’ টাকা। কুয়াকাটা রাখাইন মার্কেট থেকে যেমন এগুলো বিক্রি হয়, তেমনি তাদের পল্লী থেকেও অনেকে এসে কিনে নিয়ে যায়। ব্যাপক চাহিদা আছে বলেই তাঁত শিল্পটিকে তারা এখনও ঐতিহ্যের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। ছাতিয়ান পাড়ার সবচেয়ে বয়সী নারী অং তিয়েন (৯২) জানান, তারা পুরুষানুক্রমে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। মাঝখানে কিছুটা দিন তাঁতশিল্পের দুর্দিন গেছে। এখন আবার পুরোদমে চলছে। একই পাড়ার তাঁতশিল্পী কলেজ পড়ুয়া সাথী (২০) জানান, তারা এখন ডিজাইন এবং রঙের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিত্য নতুন ডিজাইন বের করার চেষ্টা করছেন। যে কারণে বিদেশীরাও বেড়াতে এসে তাদের লুঙ্গি চাদর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ঢাকায়ও লুঙ্গি সরবরাহ করতে শুরু করেছে। মোটকথা শত বছরের এ ঐতিহ্যটি রাখাইনদের আবার কোমর তুলে দাঁড়াতে সহায়তা করছে।
×