ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাপস মজুমদার

রাজনীতি সন্ত্রাসকবলিত হলেও বাজারে স্বস্তি

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রাজনীতি সন্ত্রাসকবলিত হলেও বাজারে স্বস্তি

পথের পাঁচালী, আরণ্যকখ্যাত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন আগে ব্যক্তিগত একটি পত্রে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘বেগুনের সের দুই পয়সা হইয়া গেল। মানুষ বাঁচিবে কি করিয়া!’ এরও অনেক দিন পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলের শেষার্ধে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক প্রথিতযশা সাংবাদিক-কলামিস্ট মুসাফিরখ্যাত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হাট-বাজার তথা দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে মনের খেদ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘ছাগলের দামে মুরগি কিনিয়া আনিলাম!’ পাঠক, যৎসামান্য বিবেচনা করলেই বেশ বুঝতে পারবেন যে, শুধু বেগুন কিংবা মুরগি খেয়ে মানুষ বাঁচে না। বেঁচে থাকতে হলে দৈনন্দিন জীবনে তাঁর চাই চাল-আটা-তেল-লবণ-চিনি, তরিতরকারি-শাকসবজি, মাছ-মাংস-ডিম ইত্যাদি। এর বাইরে রয়েছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যাতায়াত-বিনোদন-সামাজিকতা-বিয়ে-শাদী-জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি। যা হোক, অত গভীরে বিস্তারিত তত্ত্বকথায় না গিয়ে এক বাক্যে যা বলা যায় তা হলো, গত কয়েক বছর ধরে একনাগাড়ে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি রয়েছে প্রায় স্বাভাবিক ও সহনশীল পর্যায়ে। মাঝে মধ্যে দু’একটি পণ্যে হঠাৎ উল্লম্ফন যে চোখে পড়ে না, তা নয়। তবে সেটা কখনই আকাশচুম্বী বা হাহাকারের পর্যায়ে যায়নি। বেশি কি লিখব, অতীতে আমরা দেখেছি যে, বিশেষ করে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহায় দ্রব্যমূল্যে পাগলা ঘোড়া ছোটার উপক্রম ঘটে। গত কয়েক বছরে তাও পরিলক্ষিত হয়নি। দু’একটি পণ্য, যেমন ভারতে মূল্যবৃদ্ধির কারণে পেঁয়াজ, কিছুটা অস্থিরতা দেখা গেলেও সরকার মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন অথবা বিকল্প উৎস থেকে জরুরী ভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। এও সত্য, রমজান অথবা ঈদে পেঁয়াজ, ছোলা, বেগুন, ধনেপাতা, শসা, ফলমূল, দুধ, ঘি, মসলার দাম কিছুটা বাড়ে বটে। এ সময়ে এসবের চাহিদাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। যদিও সংযম ও মিতাহারের মাস, তবুও বাস্তবতা হলো মানুষ তখন ভাল-মন্দ আহার্যবস্তু গ্রহণ করে থাকে বেশি পরিমাণে। একশ্রেণীর পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী এর সুযোগ গ্রহণ করে বৈকি! মূলত এ শ্রেণীর সংখ্যাই বেশি। বিদেশে, ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গেও পূজা-ঈদ-ক্রিসমাস ও খ্রিস্ট নববর্ষ ইত্যাদি পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষে মূল্যছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সেসব সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রাহকদের হতাহতের ঘটনাও ঘটে। আর আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টো। মুনাফা অনেক বেশি করেন ব্যবসায়ীরা। সারাবছর ধরে তারা লাভ তো করেনই, পালা-পার্বণ উপলক্ষে তাঁদের লভ্যাংশের আকাক্সক্ষা বেড়ে যায় বহুগুণ। মিন মিন করে কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও এটাই বাস্তবতা। এসব সত্ত্বেও বলব, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বেশি সাফল্য বুঝি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা বাজার পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেয়ার মধ্যে। এ প্রসঙ্গে আমরা অবশ্যই ভুলে যাচ্ছি না যে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নানাবিধ সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণে সরকার নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সাফল্যও অর্জন করেছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্য নিরাময়ে সরকারের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পর্যন্ত প্রশংসিত। স্যানিটেশনসহ বিশুদ্ধ পানীয়জল সরবরাহে আমাদের অর্জন অন্তত ভারতের তুলনায় অগ্রসর ও ভাল। বিশ্বখ্যাত বাঙালী অর্থনীতিবিদ নোবেলপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন পর্যন্ত এক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্জনের মুক্তকণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তা সত্ত্বেও বলব, আমাদের আত্মপ্রসাদের কিছু নেই এতে। প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক দূর যেতে হবে এসব ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য অর্জনের জন্য। এও সত্য, গত কয়েক বছরে এসব ক্ষেত্রে ব্যয় কিছুটা বেড়েছেও। খুলনা-সাতক্ষীরা-বরিশালসহ দক্ষিণ বাংলা, চরাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কাজ করতে হবে দারিদ্র্য বিমোচনসহ সামাজিক সূচক অর্জনের ক্ষেত্রে। তবে এও সত্য, এসব অর্জনে সরকারের সামনে নানা বাধাবিঘœ ও সমস্যাও বর্তমান। চলমান সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন এর অন্যতম। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে অথবা টিভির সুইচ অন করলেই ভেসে ওঠে নানাবিধ রাজনৈতিক সহিংসতার খবরাখবর। বোমা মেরে অথবা পেট্রোলবোমা ছুড়ে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ ছাপোষা মানুষ। হামলা হচ্ছে পণ্যেদ্রব্য পরিবহনের ট্রাক ও কন্টেনারে। আগুন দেয়া হচ্ছে যাত্রীবাহী বাসে। ঢাকা-রংপুর ও অন্যত্র মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে প্রায় প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে আগুনে দগ্ধ রোগী। মারাও যাচ্ছে বৈকি! এই মৃত্যু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক এবং নিছক সংখ্যা দিয়ে এর পরিমাপ করা যাবে না। বিবিধ যানবাহনে প্রায় নিত্য হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পণ্য পরিবহনে সমস্যা সঙ্কটসহ সার্বিক গতি কমে এলেও রাজধানীর বাজার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক বলা চলে অন্তত এ পর্যন্ত। সরবরাহজনিত পরিস্থিতির কারণে আপাতত গরু-মুরগি-খাসি তেলসহ কয়েকটি পণ্যে কিঞ্চিত উর্ধগতি দেখা দিলেও তরিতরকারি, শাক-সবজি, আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি মোটামুটি সস্তাই বলতে হবে। চাপ রয়েছে চালের বাজারে। কেননা উত্তরবঙ্গ থেকে পর্যাপ্ত চাল আসতে পারছে না। তবে সরু ও সুগন্ধি চালের দাম স্থিতিশীল। ফলমূলের দাম অপরিবর্তিত। মাছের দামও কোন অবস্থাতেই অসহনীয় নয়। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, সরকার এই ডামাডোল, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হানাহানির মধ্যেও শেষ পর্যন্ত বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে ও হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ইতিবাচক অবদানও কম নয়। গার্মেন্টস সেক্টরসহ বড় ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, তাঁদের হাজার হাজার কোটির টাকার ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে। বেশ কিছু অর্ডার বাতিল হয়েছে এর মধ্যে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপও আছে। সরকার থেকে অবশ্য জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই বড়জোর সপ্তাহখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণসহ আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় অনিবার্য একটি প্রশ্ন তথা বির্তক উপস্থিত হয়েছে বহু কথিত সুশীল সমাজ, বিদগ্ধমহল ও সুধী সমাজে। গণতন্ত্র নাকি উন্নয়ন- কোন্্টি আগে? বেশ বোঝা যায়, এ বির্তক চলবে আরও কিছু দিন ধরে। আপাতত আমরা বলি উন্নয়ন। গণতন্ত্রের নামে জ্বালাও-পোড়াও, বাস-ট্রাকে আগুন, পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যা, ব্যাপক প্রাণীহানিসহ সম্পদহানি সর্বোপরি অনুন্নয়ন কাম্য নয় কোন অবস্থাতেই। সমর্থনযোগ্যও নয়। তদুপরি গণতন্ত্রের নামে দেশবিরোধী, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কোন দল তথা অপশক্তিকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া ঠিক হবে না কিছুতেই। এ ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনে বিএনপি হয়ত বলতে পারে, আমরা তো স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। ভাল কথা- তবে জামায়াত-শিবির! এরা তো রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করেছে দেশের বিরুদ্ধে। তারা তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। আর বিএনপি তো তাদের পক্ষেই আছে। জোটেও নিয়েছে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ তাঁর দলবল দাবি করেন- তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ প্রহরা তুলে নেয়ার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর সাজগোজ তথা চুলের বাহারের তো কোন কমতি দেখা গেল না। এমনকি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে। সে ক্ষেত্রে তো বলতেই হয়, যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই তিনি ছিলেন সেখানে। আর আইনের দৃষ্টিতে তো তাঁর ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক। বৈধ কী অবৈধ উপায়ে- সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। সেই তারেক রহমান লন্ডনে বসে ইটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে যে ভাষণ দিলেন, সে তো এককথায় গেরিলা যুদ্ধ তথা জিহাদ ঘোষণার শামিল দেশের বিরুদ্ধে। সে অবস্থায় বিএনপির অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যুক্তি তো ধোপে টিকে না কিছুতেই। বিএনপি যদি একটি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দলই হয়ে থাকে, তা হলে রুহুল কবির রিজভী হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেলেন কেন? কেনইবা তিনি পলাতক অবস্থায় ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সময় সময় ডাক দেন অবরোধের, ডাক দেন হরতালের। বিএনপি কি কোন আন্ডারগ্রাউন্ড দল? অবশ্য ইতোমধ্যে রিজভীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও টক শোওয়ালারা বলেন, বিএনপি তো দাঁড়াতেই পারছে না রাস্তায়। ভাল কথা। দাঁড়াতে না পারলে শুয়ে পড়বে। জেলে যাবে। প্রশ্ন হলো এ পর্যন্ত ক’জন নেতাকর্মী স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছেন? অত্যাচার নির্যাতন সয়েছেন? প্রকৃতপক্ষে বিএনপির গণতন্ত্র নিয়ে সন্দেহ আছে বিস্তর জনমনে। কেননা দলটি ক্ষমতায় এসেছে এবং তৈরিও হয়েছে অবৈধ উপায়ে। সরকার হয়ত কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছে, এই যেমন বিএনপিকে জনসভা করতে না দেয়া, বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি। তবে বিএনপিও যে অতীতে ভাল কিছু করেনি এবং এখনও করছে না, এ কথা এক বাক্যে বলা যায়। এর সর্বশেষ উদাহরণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না দেয়া। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি যে এত গলাবাজি ও রক্তবমি করছে, সেই ব্যবস্থাকে তো শেষাবধি পচিয়েছে বিএনপিই- ড. ইয়াজউদ্দিনকে এর প্রধান করে। এমনকি চলমান এসএসসি পরীক্ষাকে জিম্মি করে রেখে বিএনপির সহিংস আন্দোলনকেও ভাল চোখে দেখছে না কেউই। যা হোক, রাজনীতি আমাদের বিষয় নয়। আমাদের বিষয় বাজার পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতি। সন্ত্রাস-সহিংস কর্মসূচীসহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা নয়। বিএনপি-জামায়াতকে সেই পথ থেকে সরে আসতে হবে অবিলম্বে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায়সহ অতীতের পাপস্খলন করতে হবে জনতার দরবারে নতজানু হয়ে। জনগণের কাছে হার স্বীকার, পরাজয়ের লজ্জা বলে কিছু নেই। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি আদৌ তা করবে? লেখা শুরু করেছিলাম বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে এর সুফল মেলে অবশ্যই। এর মধ্যে দারিদ্র্য কমেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। পণ্যমূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল। খাদ্য, বিশেষ করে ধান-চাল-শাক-সবজি-মাছ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন বাংলার কৃষক ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। একে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। এহেন উন্নয়নের অংশীদার ও শরিক হতে হবে সরকারকেও। সে জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ সুনিশ্চিত করতে হবে আইনশৃঙ্খলা। সন্ত্রাস ও সহিংসতার কাছে সাধারণ মানুষ, দেশ ও জাতিকে জিম্মি করা চলবে না কিছুতেই। আর এর জন্য যা যা করণীয়, সরকার তা নিশ্চয়ই করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক জনজীবনের নিরাপত্তা চাই। চাই যে কোন মূল্যে তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি।
×