ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলে ফাইনালে খেলার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশ

হেমন্তের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

হেমন্তের প্রত্যাশা

রুমেল খান ॥ ‘রাতে অনেক ভাল ঘুম হয়েছে। যদিও একটু দেরি করেই ঘুমিয়েছি। লঙ্কাকে হারিয়ে আমরা মাঠে তেমন উল্লাস করিনি, সেই উল্লাস করেছি রাতে হোটেলে ফিরে। অনেক মজা করেছি সতীর্থদের সঙ্গে।’ কথাগুলো যার, তিনি হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস। যার গোলে শীতের মাঝে যেন বয়ে গেছে বসন্তের মাতাল সমীরণ। সোমবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে চলমান আন্তর্জাতিক ফুটবল আসর ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ’-এর ‘এ’ গ্রুপের শেষ ম্যাচে স্বাগতিক বাংলাদেশ ১-০ গোলে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়। জয়সূচক গোলদাতা ছিলেন হেমন্ত। মঙ্গলবার বাংলাদেশ দল মাঠে কোন অনুশীলন করেনি। তবে হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থানকালে একেবারে অলসভাবেও বসে থাকেনি। জিম এবং সুইমিং করেছে। তারপরই কথা হয় এই তরুণ তুর্কীর সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, ‘ম্যাচ শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গেও ফোনে কথা হয়েছে। তারা অনেক খুশি হয়েছেন, দোয়া করেছেন। বলেছেন আমাকে আরও ভাল খেলতে হবে।’ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে গোল মিস প্রসঙ্গে হেমন্তর ভাষ্য, ‘লঙ্কার বিরুদ্ধে ম্যাচে আরও গোল করতে পারতাম। হয়ত হ্যাটট্রিকটাও হয়ে যেত। কিন্তু গোলের একাধিক সুযোগ নষ্ট হওয়াতে সেটা আর হয়নি। এ জন্য দারুণ আফসোস হচ্ছিল। তবে ম্যাচ শেষে সব আক্ষেপ দূর হয়ে গেছে। কেননা, বাংলাদেশ জিতেছে আর জয়সূচক গোলটি আমার পা থেকেই এসেছে।’ সেমিফাইনালে কোন দলকে আশা করছেন। সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এলো, ‘সেমিতে আমি প্রতিপক্ষ হিসেবে থাইল্যান্ডকেই প্রত্যাশা করছি।’ ‘আগেই বলেছিলাম এদেশে অনেক প্রতিভাবান ফুটবলার আছে। ছেলেরা আবারও সেটি প্রমাণ করেছে। ১৮ বছরের একটি ছেলে আজ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পারফর্ম করেছে!’ কথাগুলো বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ডাচ্ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের। সোমবার ম্যাচ শেষে ক্রুইফ যার সম্পর্কে প্রশংসা করেন, তিনি মিডফিল্ডার হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস। মাঘের তীব্র শীতে ম্যাচের জয়সূচক গোলটি করে যেন তিনি বইয়ে দেন একরাশ হেমন্তের মাতাল সমীরণের স্নিগ্ধ পরশ। ভাল খেলেন, তাই মিডফিল্ডার হওয়ার পরও হেমন্তকেই দলের ১০ নম্বর জার্সিটি দিয়েছেন ক্রুইফ। তার আস্থার যোগ্য প্রতিদানই দিলেন ঢাকা মোহামেডানের এই কৃতী ফুটবলার। জাতীয় অনুর্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক থেকে আজ তিনি জাতীয় দলে এবং দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। গত মৌসুমে ৫ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে মোহামেডানে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ, চ্যাম্পিয়নশিপ লীগে খেলে সুযোগ পান জাতীয় অনুর্ধ-১৯ দলে। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে খেলেন ইরাকে অনুষ্ঠিত ‘এএফসি অনুর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর বাছাইপর্বে। দিনাজপুরের ছেলে তিনি। পুরো পরিবারই ফুটবল পাগল। বাবার হাতেই ফুটবলের হাতেখড়ি। বাবা দিনাজপুরের জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলতেন। তার একটি মহিলা ফুটবল দলও ছিল। তার দুই ভাইও ফুটবলার। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ ক্লাবের কোচ তো বটেই, জাতীয় দলের ভিনদেশী কোচেরও বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছেন। অথচ বয়স তার এখনও ২০ ও হয়নি। প্রমাণ চান? তাহলে ফিরে চলুন গত বছরের ৫ মার্চ তারিখে। সেদিন গোয়ায় স্বাগতিক ভারতের বিরুদ্ধে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ডাচ্ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ সারপ্রাইজ দিলেন দু-দুটো। প্রথমত হেমন্তকে প্রথম একাদশে রেখে, দ্বিতীয়ত তাকে দশ নম্বর জার্সিটি পড়তে দিয়ে। অথচ এর যোগ্য দাবিদার ছিলেন ফরোয়ার্ড জাহিদ হাসান এমিলি, যিনিও ছিলেন ওই ম্যাচে। অনেকেই ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন, অল্পবয়সী হেমন্তকে দশ নম্বর জার্সি দিয়ে ভুল করেছেন ক্রুইফ। কিন্তু ক্রুইফ যে সঠিক ছিলেন, সেটা প্রমাণ হয় হেমন্তর অসাধারণ নৈপুণ্যে। আত্মবিশ্বাস আগেই ছিল, সেটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় ওই ম্যাচের পর। এরপর নিজ ক্লাবের কোচও আস্থা রাখতে শুরু করেন হেমন্তর ওপর। স্বাধীনতা কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। আর দলকে শিরোপা জেতাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এই তরুণ। বিশেষ করে কোয়ার্টার ফাইনালে মুক্তিযোদ্ধা এবং আবাহনীর বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে মোহামেডান একটি করে গোল করে এবং ম্যাচ জেতে। দুই ম্যাচেই দুটো গোলেরই নেপথ্য রূপকার ছিলেন হেমন্ত। তখন দলীয় অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি বলেছিলেন, ‘ও পাওয়ার ফুটবল খেলে, যা আমাদের খেলায় তেমন দেখা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখবেন, ওর মাংশপেশির শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে সে আমাদের ডিফেন্সেকে ভালভাবে ছায়া দেয় বলেই ডিফেন্সের ওপর চাপ কম পড়ে।’ দিনাজপুরের আদিবাসী এ তরুণের শারীরিক গঠন সাধারণের চেয়ে একটু আলাদা। পুরো ৯০ মিনিট একই গতিতে খেলা এবং একই সঙ্গে রক্ষণ ও আক্রমণে সমান ভূমিকা রাখার বিশেষ ক্ষমতা আছে। ঠিক যেন ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার রবার্তো কার্লোসের মতো। নিঃসন্দেহে এ তরুণের আছে অপার সম্ভাবনা। সেটা বুঝেই ক্রুইফ গত বছরের ডিসেম্বরে তাকে পাঠিয়েছিলেন ডাচ্ ফুটবল ক্লাব এফসি টুয়েন্টেতে ট্রায়ালে। সঙ্গী হয়েছিল নেপালের আরেক ফুটবলার বিমল গাড়তি মাগর। ট্রায়াল শেষে বিমলের ভাগ্য খুলে যায় বেলজিয়ামের এক ক্লাবে। হেমন্ত দেশে ফিরে এলেও মাথায় রয়ে গেছে ইউরোপের পোকা। ক্রুইফও নাকি সেই স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছেন। ইউরোপকে সামনে রেখেই তাঁর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সিডিউল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি নিয়মিত জিমে যাচ্ছেন, চলছেন ক্লাবের পর্তুগীজ কোচের প্রেসক্রিপশন মেনে। তাতেই যেন হেমন্তের বসন্ত ফিরছে। উনিশ পেরোতেই তার মধ্যে নতুন তারকার ঝঙ্কার শোনা যাচ্ছে। আসলাম, কায়সার, মুন্না, সাব্বির, রুমী, আলফাজ, আমিনুলের পর কি হেমন্ত হতে পারবেন দেশীয় ফুটবলে আরেকজন নতুন তারকা ফুটবলার? সময়ই বলে দেবে তা।
×