ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শামসুদ্দীন আবুল কালাম;###;মাইনুল ইসলাম নাসিম

নির্জন প্রান্তরের একাকী বৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নির্জন প্রান্তরের একাকী বৃক্ষ

শামসুদ্দীন আবুল কালামের দুঃখজনক মৃত্যুর সময় ১৯৯৭ সালে এই প্রতিবেদক রোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের পাশাপাশি ঐ সময়কার ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের ইতালি প্রতিনিধির দায়িত্বে থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেননি কিছুই। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমানসহ সবাই জানতে পারেন রোমে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। পরে জানা যায়, শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর নির্জন এ্যাপার্টমেন্টে মারা যাবার বেশ অনেক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল বহুতল ভবনের বাইরে থেকে জানালা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করে। শামসুদ্দীন আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধারের পর ডকুমেন্টে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় পরিচয় না থাকায় এবং আত্মীয় বা নিকটজন কারও কোন সন্ধান পুলিশ না পেয়ে মূলত ‘বেওয়ারিশ’ লাশ হিসেবে তাঁকে রোমের এক প্রান্তে ‘প্রিমাপর্তা’ এরিয়াতে খ্রিস্টান গোরস্তানে সমাহিত করে। পাশে মুসলিম গোরস্তান থাকলেও ‘রক্ত-সম্পর্কীয়’ নিকটজনের অনুমতি না পাওয়ায় আজও স্থানান্তর করা হয়ে ওঠেনি বাংলার এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের সমাধি ‘কাশবনের কন্যা’ খ্যাত কথা সাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম আজ যেন কালের ধুলায় বিস্মৃত এক নাম। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের অন্যতম শক্তিশালী এই ঔপন্যাসিক আজ অনাদরে, অবহেলায় শায়িত আছেন সুদূর ইতালিতে। কেউ তাঁর খোঁজ রাখে না। রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। ‘কেউ কথা রাখে না’র মতো দেশের মানুষও আজ তাঁকে মনেও রাখে না। কেন এমন পরিণতি হলো তাঁর? এর জন্য কি তিনি দায়ী? নাকি অন্য কেউ? ১৯৯৭ সালের এই দিনে ইতালির রাজধানী রোমে এক নির্জন এ্যাপার্টমেন্টে জীবনাবসান ঘটে প্রচ- আত্ম-অভিমানী এই মেধাবী বাঙালীর। ১৯৫৯ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন তিনি ইতালিতে। দেশটির ‘প্রথম বাংলাদেশী’ শামসুদ্দীন আবুল কালামের জন্ম ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের বরিশালে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইতালি থেকেই ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৭ ইতালিতে সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের প্রবাস জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করলেও দেশটির কর্মক্ষেত্রে ছিল তাঁর সফল পদচারণা। সত্তরের দশকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম কর্মরত ছিলেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) রোমের সদর দফতরে এবং ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাসে। ইতালিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও ছিল তাঁর পদচারণা। ইতালিতে আসার আগেই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের বেশ ক’টি বিখ্যাত উপন্যাস। বিখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের সবচাইতে সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘কাশবনের কন্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। পরে পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাতে আসে উপন্যাস- দুই মহল (১৯৫৫), কাঞ্চনমালা (১৯৫৬), জীবন কা- (১৯৫৬), জাইজঙ্গল (১৯৭৮), মনের মতো স্থান (১৯৮৫), সমুদ্রবাসর (১৯৮৬), যার সাথে যার (১৯৮৬), নবান্ন (১৯৮৭) ও কাঞ্চনগ্রাম (১৯৮৭)। ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্প সংগ্রহ ‘অনেক দিনের আশা’। পরের বছর ‘ঢেউ’ ও ‘পথ জানা নেই’। দুই হৃদয়ের তীর (১৯৫৫) এবং সাহের বানু (১৯৫৭) এই বাঙালী গুণীজনেরই অমর সৃষ্টি। ১৯৫৯ সালে ইতালি পাড়ি জমাবার আগে সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি তিনি। কন্যা ক্যামেলিয়ার জন্মের পর স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হলে অভিমানবশত তিনি চলে যান ইতালি। ক্যামেলিয়া রয়ে যায় দেশে। ক্যামেলিয়া কিছুদিন চাকরি-বাকরি, মডেলিং ও অভিনয় জগতে থাকলেও এক সময় বাবার মতোই পাড়ি জমান প্রবাসে। ১৯৯৭ সালে শামসুদ্দীন আবুল কালামের মৃত্যুর সময় নিউইয়র্কেই অবস্থান করছিলেন ক্যামেলিয়া। তার উদাসীনতার কারণেই মূলত শামসুদ্দীন আবুল কালামের সমাধি বিগত বছরগুলোতে রোমের খ্রীস্টান গোরস্তান থেকে পাশেই মুসলিম গোরস্তানে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। সত্তর ও আশির দশকে ইতালিতে ছিল খুব স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস। নব্বইর দশকে দেশটিতে বাংলাদেশীদের আগমন দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও স্বদেশীদের সঙ্গে খুব একটা মেশা হয়ে ওঠেনি তাঁর। বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরির সূত্রে আরেক প্রবীণ বাংলাদেশী লুৎফর রহমান যিনি এখনও জীবিত আছেন, মূলত তাঁর সঙ্গেই কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাত হতো শামসুদ্দীন আবুল কালামের। আত্ম-অভিমানী এই কথাসাহিত্যিক জীবনের শেষ দিনগুলোতে এতটাই জীবনবিমুখ হয়ে উঠেছিলেন যে, ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও বাজার করতেন না এবং অনেকটা না খেয়েই ধীরে ধীরে ধাবিত হন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। শামসুদ্দীন আবুল কালামের দুঃখজনক মৃত্যুর সময় ১৯৯৭ সালে এই প্রতিবেদক রোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের পাশাপাশি ঐ সময়কার ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের ইতালি প্রতিনিধির দায়িত্বে থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেননি কিছুই। প্রবীণ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমানসহ সবাই জানতে পারেন রোমে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। পরে জানা যায়, শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর নির্জন এ্যাপার্টমেন্টে মারা যাওয়ার বেশ অনেক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল বহুতল ভবনের বাইরে থেকে জানালা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করে। শামসুদ্দীন আবুল কালামের মরদেহ উদ্ধারের পর ডকুমেন্টে বা অন্য কোথাও ধর্মীয় পরিচয় না থাকায় এবং আত্মীয় বা নিকটজন কারও কোন সন্ধান পুলিশ না পেয়ে মূলত ‘বেওয়ারিশ’ লাশ হিসেবে তাঁকে রোমের এক প্রান্তে ‘প্রিমাপর্তা’ এরিয়াতে খ্রীস্টান গোরস্তানে সমাহিত করে। পাশে মুসলিম গোরস্তান থাকলেও ‘রক্ত-সম্পর্কীয়’ নিকটজনের অনুমতি না পাওয়ায় আজও স্থানান্তর করা হয়ে ওঠেনি বাংলার এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের সমাধি। শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রতি ‘যারপরনাই’ উদাসীন রোমের বিশাল বাংলাদেশ কমিউনিটিও। বাংলাদেশভিত্তিক নোংরা রাজনীতি এবং ভিলেজ পলিটিক্স চর্চার ‘ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড’ খ্যাত এখানকার কমিউনিটি আজ অবধি ন্যূনতম সম্মান দেখায়নি ‘প্রিমাপর্তা’ সমাধিক্ষেত্রে শুয়ে থাকা বাংলার এই সোনার সন্তানের প্রতি। যে দূতাবাসে একদা তিনি কর্মরত ছিলেন, রোমের সেই বাংলাদেশ দূতাবাসেরও তেমন কোন মাথাব্যথা নেই শামসুদ্দীন আবুল কালামের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোন উদ্যোগ নেওয়ার। এখন একটাই অনুভূতি- আমরা বাঙালী, আমরা বাংলাদেশী, আলোর পেছনে আমাদের অন্ধকারই যে অনেক অনেক বেশি।
×