ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অবকাঠামো সুবিধা ও লোকবলের অভাব প্রকট

রোগীর চাপ সামাল দিতে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট হিমশিম

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রোগীর চাপ সামাল দিতে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট হিমশিম

নিখিল মানখিন ॥ আগুনে দগ্ধ হওয়া রোগীদের শেষ ভরসা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা এবং লোকবলের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে এ ইউনিটে। প্রতিদিন নির্ধারিত রোগীশয্যার তুলনায় তিনগুণের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে। বেঁচে থাকার আশায় দগ্ধ রোগীরা প্রতিনিয়ত ভিড় করেন সেখানে। এখন রয়েছে হরতাল-অবরোধে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ রোগীদের চাপ। অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নানা সমস্যায় জর্জরিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের চাপে সেখানে তৈরি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বর্তমানে দেশে ৫০ জন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১৬ জন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রয়েছেন। দেশে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি প্লাস্টিক সার্জন দরকার। এক বছরে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৫১ হাজার রোগী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশে ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া এই ইউনিটটি ২০০৩ সালে ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। প্রতিবছর রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ইউনিটটির সার্বিক অবকাঠামোর তেমন সক্ষমতা বাড়েনি। ক্রমবর্ধমান রোগীর চাপ সামাল দেয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণে ২০১৩ সালের ১২ নবেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বার্ন ইউনিটকে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি’ পরিণত করার প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে এখনও কোন ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। এদিকে, পোড়া দেহের অসহ্য যন্ত্রণা ও ছটফটানি নিয়ে নির্ধারিত রোগীশয্যার তুলনায় তিনগুণের বেশি রোগী প্রতিদিন চিকিৎসাধীন থাকছে। বেঁচে থেকেও মৃত্যু-যন্ত্রণা উপশমের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেই পর্যাপ্ত জনবল। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই সামাল দিতে হয় অধিকসংখ্যক রোগীকে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হরতাল-অবরোধে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেখতে গিয়েছিলেন বার্ন ইউনিটে। সেই সময় পোড়া রোগীদের চিকিৎসার করুণ অবস্থা দেখে ৫০ বেডের বার্ন ইউনিটকে ১০০ বেডে উন্নীত করার নির্দেশনা দেন। সঙ্গে জনবলসহ অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করারও ঘোষণা দেন। প্রতিদিন পোড়া রোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। চাহিদার তুলনায় বার্ন ইউনিটের সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। এ অবস্থার মধ্যে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০০ বেডের বার্ন ইউনিটকে ৩০০ বেডে উন্নীত করার ব্যবস্থা করেন। ৩০০ বেডের বার্ন ইউনিট হলেও এর জনবল ১০০ বেডেরই থেকে যায়। ৩০০ বেডের এ বার্ন ইউনিটে প্রতিদিন চিকৎসাধীন রোগী থাকে ৫ শতাধিক। আর বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য আসেন ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী। হাসপাতালের বেডে রোগীর স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় রোগীদের মেঝের মধ্যে রেখে হলেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এখনও রাজস্ব খাতে না যাওয়ায় লোকবল নিয়োগেও এই ইউনিটে রয়েছে নানা সঙ্কট। নেই প্রয়োজনীয় নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ প্রয়োজনীয় কর্মচারী। বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, এই ইউনিটে বর্তমানে ১৬ জন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন। ১৩ জন ওএসডিতে মেডিক্যাল অফিসার ও ২৯ জন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী। নেই প্রয়োজনীয় নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ প্রয়োজনীয় কর্মচারী। নার্স আছে ৩০ জন। বার্ন ইউনিট এখনও রাজস্ব খাতে না যাওয়ায় লোকবল নিয়োগে নানা সঙ্কটের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সূত্রটি আরও জানায়, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা এবং লোকবলের অভাব রয়েছে। নির্ধারিত রোগীশয্যার তুলনায় তিনগুণের বেশি রোগী প্রতিদিন চিকিৎসাধীন থাকছে। ‘১শ’ বেডের বাজেট দিয়ে সাড়ে ৩শ’এর চিকিৎসা করা একটা অসুবিধা।‘বার্ন ইউনিটকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট করার প্রশাসনিক কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে, সরেজমিন ঘুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। সব ওয়ার্ড ও বারান্দা ভর্তি রোগী। দর্শনার্থীদের ভিড়। পোড়া রোগীর বিছানার পাশেই রোগীর লোকজনের নোংরা জিনিসপত্র রাখা রয়েছে। বিছানা না পেয়ে অনেক রোগীকে ফ্লোরে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা গ্রহণে অসুবিধা হতে পারে, এমন কথা বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেন অনেক রোগী ও তাঁদের অভিভাবক। তাঁরা অভিযোগ করেন, অনেক আশা নিয়ে ভর্তি হলেও বার্ন ইউনিটে ভাল চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসক ও নার্সদের দেখা পাওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে ড্রেসিং করানো হয়। তারপর অনেক সময় ব্যথানাশক দিয়ে শুইয়ে রাখা হয় রোগীকে। সব ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। ওষুধ কেনা ও পরীক্ষা করানোর টাকা সঠিক সময়ে না পেলে রোগীকে অনেকটা চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। অনেক রোগীকে ফ্লোরে ঘেষাঘেষি অবস্থায় থাকতে হয়। বেশি দগ্ধ রোগীদের দেখলে তুলনামূলকভাবে কম দগ্ধ রোগীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
×