ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা ॥ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সংক্ষুব্ধ নন তিনি

রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে, তদন্তে সামনে আসছে অসংখ্য প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে, তদন্তে সামনে আসছে অসংখ্য প্রশ্ন

শংকর কুমার দে ॥ ক্রমেই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার (গুলিবিদ্ধ) ঘটনাটি। অসহযোগিতা করে হামলার ঘটনাটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন রিয়াজ রহমান ও তার পরিবার। ঘটনার পর গত ২৫ দিনে তদন্তে অসংখ্য প্রশ্ন সামনে আসছে, কিন্তু কোন উত্তর নেই, এমনই এক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে পড়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সাধারণত যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা সংক্ষুব্ধ হন। রিয়াজ রহমান ‘ক্ষতিগ্রস্ত’। অথচ তারা ‘সংক্ষুব্ধ’ নন। তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন কথা বলা তো দূরের কথা দেখাও করছেন না। এমনকি ঘটনার সময়ের গাড়ির চালকের নাম -পরিচয়ও প্রকাশ করছেন না তারা। গাড়ি চালক কোথায় আছেন জানেন না তদন্ত কর্তৃপক্ষ। ঘটনার সময়ে আশপাশের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় (সিসি ক্যামেরা) ধারণ করা পথচারী, মোটরসাইকেল আরোহী, প্রাইভেটকার, দৌড়াদৌড়ির দৃশ্যও অস্পষ্ট। তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। যা বলেন তদন্তকারীরা ॥ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি শেখ নাজমুল আলম, এডিসি মাহফুজুল ইসলাম জানান, গত ১৩ জানুয়ারি রাতে গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বরের দক্ষিণ দিকের ৪৬ নম্বর সড়কের ১০তলা বিলকিস টাওয়ারের নিচে ঢাকা ব্যাংকের সামনে রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার পর তদন্তকারী অফিসার (আইও) তার ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন তিন বার। দুই বার দেখা করার চেষ্টা করেছেন তদারককারী অফিসার (সুপারভাইজিং অফিসার)। রিয়াজ রহমানের শরীর খারাপ, অতএব তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। এমনকি তার পরিবারের পক্ষ থেকেও কেউ কথা বলার জন্য দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন আলোচ্য সময়ে। রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনাটি কি গুলিবিদ্ধের নাকি অন্য কিছু, তাও জানানো হচ্ছে না। তিনি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলাও করা হয়নি। নিরূপায় হয়ে মামলা করা হয়েছে পুলিশ বাদী। এখন তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও যদি কথা বলে, তথ্য দিয়ে সাহায্য না করেন তাহলে কি করার আছে ? এই ধরনের প্রশ্ন তুলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণত যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারাই সংক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিকার কামনা করেন। তার ওপর হামলা হলো, কারা হামলা করল, কি কারণে হামলা হলো; তা চেপে যাচ্ছেন তিনি ও তার পরিবার। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি মাহফুজুল ইসলাম জানান, ঘটনার সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী রিয়াজ রহমানের গাড়ির ড্রাইভার। তিনি ও তার পরিবারের কাছ থেকে গাড়ির ড্রাইভারের নাম-পরিচয় পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না এমনকি ড্রাইভার কোথায় আছেন তাও জানা যাচ্ছে না। তিনি কি গুলিবিদ্ধ এমন প্রশ্নের উত্তরে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, তার ওপর হামলার ঘটনায় মেডিক্যাল রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে না। ঘটনার পর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এখন বনানীর বাসভবনে আছেন রিয়াজ রহমান। দৈনিক জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে রিয়াজ রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন ধরেন বোন আমিনা রহমান। মুঠোফোনে রিয়াজ রহমানকে চাওয়া হয়। আমিনা বেগম জানান, রিয়াজ রহমানের শরীর খারাপ। তার মুঠোফোন বন্ধ। তার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ‘আই এ্যাম সরি’ বলে ফোন রেখে দেন আমিনা বেগম। কিভাবে আহত তা এখনও অনুদ্ঘাটিত ॥ গুলশান পুলিশ আহত রিয়াজ রহমানকে উদ্ধার করে ভর্তি করেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। ঘটনার পর দিন গত ১৪ জানুয়ারি বুধবার ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অপারেশন বিভাগের পরিচালক ডাঃ দবির উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, রিয়াজ রহমানের ক্ষতস্থান দিয়ে কিছু রক্ত ঝরছিল এবং রোগীকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছিল। ক্ষতের মুখগুলো অনেকটা পুড়ে যাওয়া। কোন তপ্ত ধাতব পদার্থ বিদ্ধ হয়ে ভেদ করে বের হওয়ার মতো। রোগীর শরীরে ধাতব পদার্থ না থাকায় অপারেশনের প্রয়োজন নেই। সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ পরীক্ষা ॥ গুলশানের ঘটনাস্থলের যেখানে রিয়াজ রহমান হামলার শিকার হয়েছেন সেখানকার কোন ভবনে সিসিটিভি ছিল না। সরেজমিনে দেখা গেছে, ডরিন টাওয়ারের সামনে যে সিসিটিভি লাগানো রয়েছে, সেখান থেকে ঘটনাস্থল অস্পষ্ট দেখা যায়। গোলচত্বরসহ রাস্তার খানিকটা অংশ সিসিটিভির আওতায় রয়েছে। তিনটি সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। রাত ও গাড়ি আর রাস্তার আলোর কারণে ফুটেজগুলো একেবারেই ঝাপসা। ঝাপসা ফুটেজে চারটি মোটরসাইকেলের অস্তিত্ব মিলেছে। এরমধ্যে তিনটি মোটরসাইকেলে থাকা আরোহীদের সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। কিন্তু মোটরসাইকেলের গতি সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর পর সাধারণত যেমন থাকা স্বাভাবিক তেমন মনে হয় না। মনে হচ্ছে, রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে চলা মোটরসাইকেল। ঘটনা পরিকল্পিত কিন্তু উদ্দেশ্য হত্যা নয় ॥ তদন্তকারীদের ধারণা, রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার স্থান ও ধরন পরিকল্পিত। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করা হয়নি। সেটি তদন্তে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত। রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার পর তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আরেক উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিনের গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা একইসূত্রে গাঁথা কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক মাঠ গরমের পাশাপাশি চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতেই পরিকল্পিতভাবে ঘটনা দুইটি ঘটানো হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনারই তদন্ত করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত অথচ সংক্ষুব্ধ নন ॥ রিয়াজ রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে এমন এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, রিয়াজ রহমানের ওপর হামলার ঘটনাটি কারা-কিভাবে ঘটিয়েছে সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। প্রকৃত ঘটনা বললে সত্য বলার অপরাধে বিএনপি ও চেয়ারপার্সনের রোষানলে পড়তে পারেন। এর চেয়ে চেপে গেলে অন্তত অদূর ভবিষ্যতে মন্ত্রিত্বের পদটি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রিয়াজ রহমান একজন ঝানু কূটনীতিক, তাই তিনি ঘটনার বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখাটাকেই শ্রেয় মনে করছেন। সাজানো নাটকের ঘটনা কি? ॥ তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, রিয়াজ রহমানের ঘটনাটি অনেকটা ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার’ প্রবাদের মতোই। বিএনপি অবরোধ-হরতাল ডেকে পেট্রোলবোমার আগুনে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষজনকে পুড়িয়ে হতাহত করে উল্টা তারা দোষ দিচ্ছে আওয়ামী লীগকে। একই কায়দায় রিয়াজ রহমান যেহেতু একজন কূটনীতিক এবং প্রভাবশালী দেশসমূহের সঙ্গে পরিচিতিটা খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই তার গাড়িতে পেট্রোলবোমার আদলে আগুন দিয়ে তার ওপর হামলা চালালে, বিদেশের প্রভাবশালী দেশসমূহে আওয়ামী লীগের সরকার সম্পর্কে খুব সহজে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা যাবে। যাদের হুকুমে যারা পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মনুষ মারছে, তাদেরই সাজানো নাটকের কাহিনীতে পরিণত হয়ে ঘটনার টার্গেটে পরিণত হয়েছে রিয়াজ রহমান।
×