ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এমআর মাহবুব

ফিরে দেখা ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ফিরে দেখা ভাষা আন্দোলন

ঐতিহাসিক আমতলা বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরের জরুরী বিভাগের বার্ন ইউনিট এলাকা। এলাকাটি ছিল ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। এই কলাভবনের সামনে ছিল আমগাছটি। দেশের তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সকল কর্মকাণ্ড এই আমতলা থেকে পরিচালিত হতো। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এই আমতলায় ছাত্র সমাবেশ থেকে নেয়া হয়েছিল। সেই থেকে আমতলা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও অমর একুশের ইতিহাসে আমতলা এক অবিস্মরণীয় স্মৃতিস্মারক। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সারাদেশে সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন নুরুল আমিন সরকার সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করেন। শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ প্রতিরোধ। উত্তেজনায় টলমল ছাত্রসমাজ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের দৃপ্ত কণ্ঠে গগনবিদারী স্লেøাগান উচ্চারিত হচ্ছে ‘১৪৪ ধারা ভাঙ্গবোই ভাঙ্গব’। অবশেষে রাতের আঁধার কেটে আসে বহু প্রতিক্ষিত একুশের ভোর। একে একে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে আসতে থাকেন আমতলায়। এই গাছের তলাতে মধুর ক্যান্টিনের যাত্রা শুরু। সকল রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রস্থল ছিল এটি। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষের বিপক্ষের সকল নেতারা মধুর ক্যান্টিন ও আমতলায় সমবেত হয়ে তর্কে বিতর্কে লিপ্ত, কেউ কেউ পিকেটিং করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। আমগাছটিও যেন জনগণের উত্তেজনা আর উত্তাপে উদ্বেলিত। এর সঞ্চারিত শাখা-প্রশাখা ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি প্রগার একাত্মতা। সকাল ১১টায় আমতলায় শুরু হয় ছাত্রসভা। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার যুক্তি দেখিয়ে বক্তব্য রাখেন। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো বিস্ফোরণমুখ ছাত্র-জনতা স্লোগান প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। অবশেষে সুঠামদেহী, তেজোদীপ্ত ছাত্রনেতা, ঐতিহাসিক এই সভার সভাপতি গাজীউল হক দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সেই অমর, অজয় বাণী। ছাত্র-জনতার স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আমতলায় বাতাস। শুরু হয় কাদানে গ্যাস, লাটিচার্জ, গ্রেফতার, পুলিশের নির্মম অত্যাচার। শত নির্যাতন সহ্য করে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে তাঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য স্লোগান ও পিকেটিং করতে থাকেন। বেলা ৩টা থেকে ৩.৫০টার মধ্যে পুলিশের গুলিতে ঝরে যায় কয়েকটি তাজা প্রাণ। ভাষাশহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় ব্যারাক প্রাঙ্গণ। সৃষ্টি হয় অমর একুশে, বীজ রোপিত হয় স্বাধীনতার। অমর একুশে আজ আমাদের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, আমাদের গৌরব। আমাদের এই মহৎ অর্জনের পেছনে ঐতিহাসিক আমতলার রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ২১ ফেব্রুয়ারি যদি আমতলার সেই সমাবেশ থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঘোষণা না দেয়া হতো তাহলে ইতিহাস হয়ত অন্যরকম হতো। আমতলার ঘোষণার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল একুশের রক্তাক্ত অধ্যায়। সে কারণেই আমতলা ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক আমতলা আজ আর নেই। ১৯৯৫ সালের ২২ নবেম্বর কেটে ফেলা হয় ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমগাছটি। গোপাল দাসের সক্রিয় উদ্যোগে গাছটির একটির বড় অংশ বর্তমানে সংরক্ষিত আছে ডাকসু সংগ্রহশালায়। ১৯৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দ একটি প্রতীকী আমগাছ রোপণ করেন ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯। সেটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় একটি আমগাছের চারা রোপণ করেন। সে গাছটিরও কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে আজ গড়ে উঠেছে বিশাল ভবন। ঐতিহাসিক আমতলা আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে। লেখক : গবেষক [email protected]
×