ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে বেশি নাশকতা

সড়ক-মহাসড়কে সহস্রাধিক স্থান ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সড়ক-মহাসড়কে সহস্রাধিক স্থান ঝুঁকিপূর্ণ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক-মহাসড়কে সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান প্রায় সহস্রাধিক। এসব পয়েন্টেই চলছে নাশকতা। বেশিরভাগ বোমা হামলার ঘটনা হচ্ছে রাতে। তবে পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গ মহাসড়ক সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুই মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। সব মিলিয়ে পেট্রোলবোমায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ৬৫ জনের বেশি। সড়কের নীরব স্থানগুলো নাশকতার জন্য বেছে নিচ্ছে জামায়াত-শিবিরসহ ২০ দলের নেতাকর্মীরা। এদিকে সড়ক-মহাসড়কের ৯৯৩ পয়েন্টে এখনও আনসার মোতায়েন হয়নি। নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না নাশকতার সঙ্গে যুক্ত বেপরোয়া শিবির ক্যাডারদের। এমন বাস্তবতায় রাত নয়টার পর দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ হয়েছে। ক্ষতিপূরণের জন্য অগ্নিদগ্ধ প্রায় সাতশত পরিবহন ও মালিকের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। দ্বিতীয় পর্বের তালিকা পাঠানো হবে চলতি সপ্তাহেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন ও মালিকদের নাম উল্লেখ করে প্রথম তালিকা পাঠানো হয়েছে। শুধু পোড়া গাড়িসমূহ তালিকায় এসেছে। তিনি জানান, প্রথম পর্বে ৬৭৪টি আবেদন পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইতোমধ্যে এই তালিকায় ৫০টির বেশি অগ্নিদগ্ধ গাড়ি ও মালিকের নাম আমাদের হাতে এসেছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল করার চেষ্টা চলছে। বেশকিছু সড়ক ইতোমধ্যে সচল হয়েছে। শুধু উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রামের কিছু জায়গায়ই সমস্যা হচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে দেশজুড়ে পরিবহনকে লক্ষ করে হামলা চালানো হচ্ছে। অবরোধকারীদের লক্ষ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেশকে অচল করে দেয়া। এটা জনবান্ধব রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক কর্মসূচী হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার সোহেল জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম তালিকায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭০জনের নাম রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের তালিকা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর কথা জানান তিনি। বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান এ্যাসোসিয়েশনসহ আমাদের সমিতি থেকে তিন ভাগে তালিকা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়কে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না। সবার আগে জান ও মালের নিরাপত্তা জরুরী বলেও মনে করেন তিনি। সোমবার রাতে মালিক সমিতির সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মালিক সমিতি বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, বরিশালের গৌরনদী, গাইবন্ধার পলাশবাড়ি, তুলশীঘাট, নওগাঁ এবং রংপুর রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেসব স্থান পরীক্ষা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার পর সহসাই দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চলাচল করবে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ স্পটগুলোতে আরও বেশি সর্বক্ষণিক আনসার মোতায়েন করা হবে। এর আগে শনিবার রাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে রাজারবাগে বৈঠক করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক শহিদুল হকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। আলোচনাসভা শেষে আইজিপি শহিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দূরপাল্লার মানুষের নিরাপত্তার জন্য আমরা পরিবহন মালিকদের প্রস্তাব দিয়েছিলাম রাত ৯টার পর বাস না চালানোর জন্য। কিন্তু মালিক পক্ষ তাদের জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে পরিবহন চালনা করবেন বলে দাবি করেন। নাশকতার ব্যাপারে মালিক পক্ষ ও পরিবহন শ্রমিকরা সতর্ক রয়েছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পক্ষ থেকে মালিক পক্ষকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে। পুলিশ প্রধানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনার কথা বলেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। এর প্রেক্ষিতে সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বাস ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক পরিবহন সমিতির মাধ্যমে আমাদের সংগঠনের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনের তালিকা পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের জন্য আরও ১৫০টি পোড়া গাড়ির তালিকা হাতে এসেছে। পর্যায়ক্রমে সবই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ক্ষতিপূরণের জন্য পাঠানো হবে। তিনি জানান, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত কিছু পরিবহনের তালিকাও এবারের তালিকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধ না হলে পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের উত্তরবঙ্গসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্পটে সবচেয়ে বেশি নাশকতার ঘটনা ঘটছে। এসব স্পটে অবরোধকারীদের প্রধান টার্গেট পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনে সহিংসতা। এরই ধারাবাহিকতায় পেট্রোলবোমা, ককটেল নিক্ষেপসহ পরিবহন জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়ক-মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্পটগুলোকে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। গত ৫ জানুয়ারির পর রাতে মহাসড়কে অবরোধ-হরতালকারীদের পেট্রোল বোমায় রংপুরের মিঠাপুকুর, গাইবান্ধা ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ২২ জন দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমা হামলা রাতেই বেশি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মহাসড়কে বাস চলচালের বিষয়ে রবিবারও পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবরোধ শুরুর পর থেকেই সহাসড়কে বিজিবি-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সর্বশেষ মহাসড়কের প্রতি তিন কিলোমিটার অন্তর অন্তর মোতায়েন করা হয় আনসার। এরপরও চোরাগোপ্তা হামলাসহ নাশকতা থেমে নেই। বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবিবের কর্মীরা যাত্রীবাহী পরিবহনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মহাসড়কে নাশকতা থামছে না ॥ যাত্রী ও পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক মহাসড়কে পুলিশের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কাজ শুরু করে অবরোধ শুরুর পর পরই। উত্তরবঙ্গসহ দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জেলাসমূহে বিজিবি প্রহরায় গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও নাশকতা থামছে না। প্রতিরোধকরা যাচ্ছে না জামায়াত-শিবিরের নাশকতাকারীদের। এদিকে বিএনপি-জামায়াত জোটের অনির্দিষ্টকালীন অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচী চলাকালে সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের নিরাপত্তা ও যানবাহন চলাচল নির্বিঘœ করতে ৯৯৩ পয়েন্টে প্রায় ১২ হাজার আনসার মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়। ৩০ জানুয়ারি থেকে ২১৬ পয়েন্টে কাজ শুরু করে আনসার সদস্যরা। বাকি সব পয়েন্টে এখন আনসার মোতায়েন করার কাজ শেষ হয়নি। এছাড়া সারাদেশে সহিংসতা প্রতিরোধে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ আরও ১০ জেলায় ৫০ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী চলাকালে দেশের বিরাজমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ আরও ১০ জেলায় ৫০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করার জন্য বিজিবি’র ডিজিকে অনুরোধ করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ২০ প্লাটুন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬ প্লাটুন, খুলনা জেলায় ৪ প্লাটুন, কুড়িগ্রাম জেলায় ৩ প্লাটুন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৩ প্লাটুন, চট্টগ্রাম জেলায় ২ প্লাটুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৪ প্লাটুন, নীলফামারী ৩ প্লাটুন, কুষ্টিয়া জেলায় ৩ প্লাটুন ও ঝিনাইদহ জেলায় ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বেশিরভাগ স্থানে বিজিবি দেয়া হলেও পরিস্থিতির দৃষ্যমান খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। বিজিবি টহলে যাত্রীবাহী গাড়ি আনার সময়ও পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পণ্যবাহী পরিবহন চলছে। সারাদেশে তালিকাভুক্ত প্রায় দুই লাখ পণ্যবাহী পরিবহন থাকার কথা জানান তিনি। বলেন, পরিবহন টার্গেট করে দেশজুড়ে নাশকতা চলছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে একটি দেশ চলতে পারে না। এমন রাজনৈতিক কর্মসূচীও হতে পারে না। তাদের নিজেদের সংগঠনের পক্ষ থেকে অগ্নিদগ্ধ ১০টি গাড়ি ও মালিকের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সড়ক পরিবহন সমিতির মাধ্যমে পাঠানোর কথা জানান তিনি।
×