ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাঁচ বছরে পুনর্বাসিত হয়নি একজন ভিক্ষুকও;###;বরাদ্দ ২৫ কোটি টাকা, লুটপাটের অভিযোগ আছে ১৭ কোটি টাকার;###;ভিক্ষুকের দৈনিক গড় আয় ১ টাকা, আশ্রয়কেন্দ্রে সে পায় মাত্র ৬৭ টাকা

রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত করার স্বপ্ন ॥ ভেস্তে গেছে উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত করার স্বপ্ন ॥ ভেস্তে গেছে উদ্যোগ

আনোয়ার রোজেন ॥ রাজধানীর রাস্তায় দেখা মিলবে না কোন ভিক্ষুকের। হাত পেতে ভিক্ষা চাইবে না কেউ। ভিক্ষুকদের ধরতে নির্দিষ্ট এলাকায় পরিচালনা করা হবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কাউকে ভিক্ষা করতে দেখলেই পুলিশ ধরে নিয়ে আটকে রাখবে সমাজসেবা অধিদফতরের আশ্রয় কেন্দ্রে। পরে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার। এভাবে পর্যায়ক্রমে রাজধানীতে অবস্থানরত সকল ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হবে- বর্তমান সরকারের আগের আমলে ২০১০ সালের শেষের দিকে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন ঘোষণা দেন তদানীন্তন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। ওই ঘোষণার পরপরই শুরু হয় ব্যাপক তোড়জোড়। কেবল রাজধানীর ভিক্ষুক জরিপ কাজ পাওয়ার জন্যই আবেদন করে ৪০টির বেশি এনজিও। এ কাজে বরাদ্দ হয় ১৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে প্রাথমিকভাবে রাজধানীর সাতটি এলাকাকে সাড়ম্বরে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে টানানো হয় সাইনবোর্ড। তবে শেষ পর্যন্ত ওই সাইনবোর্ড টানানোতেই সীমিত হয়ে পড়ে রাজধানীর ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম। রাজধানীর কোথাও আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি ভিক্ষুকদের বিচরণ। প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে অবস্থানরত বিভিন্ন জেলার ২ হাজার ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত থাকলেও এ কর্মসূচীর আওতায় আনা হয় মাত্র ৩৭ জন ভিক্ষুককে। তথ্য মতে, এদের মধ্যে একজন ভিক্ষুককেও পুর্নবাসিত করতে পারেনি সমাজসেবা অধিদফতর। রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে পাঁচ বছর আগে নেয়া সরকারের উদ্যোগটি এভাবেই মুখথুবড়ে পড়েছে। বাজেট থাকা সত্ত্বেও থমকে গেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম। ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ কর্মসূচীর আওতায় নেয়া প্রকল্পের জন্য সরকার ২৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। অথচ এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর একজন ভিক্ষুককেও পুনর্বাসিত করা যায়নি! উল্টো ভিক্ষুকদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে যুক্ত ১০টি এনজিওর বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ১৭ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যথাযথ ব্যবহার হয় না; তাই সরকারও কর্মসূচীতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। গত ৪ বছরে বরাদ্দ কমেছে ২০ গুণ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৫০ লাখ টাকা! অন্যদিকে, ভিক্ষুকের দৈনন্দিন ‘আয়ের’ বিপরীতে সরকারের বরাদ্দের পরিমাণও অনেক কম। রাজধানীর একজন ভিক্ষুকের গড় দৈনিক আয় ১ হাজার টাকা, আর আশ্রয় কেন্দ্রে মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৬৭ টাকা। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ২ হাজার ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত থাকলেও জামালপুর জেলার স্থানীয় ২৯ জনসহ মোট ৬৬ জন ভিক্ষুককে এই কর্মসূচীর আওতায় আনা হয়। এদের নিজ জেলা ময়মনসিংহ ও জামালপুরে পুনর্বাসনের জন্য নেয়া পরীক্ষামূলক উদ্যোগটিও ফলপ্রসূ হয়নি। ভিক্ষাবৃত্তি বেশি ‘লাভজনক’ বিবেচনায় প্রায় সবাই আবারও ফিরে এসেছেন সেই পুরনো ‘পেশায়’। সারাদেশে বা শুধু রাজধানীতেই ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই। অথচ দুই বছর আগে মহাসমারোহে রাজধানীর ৭টি অভিজাত এলাকাকে নামকাওয়াস্তে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করেই দায় সারে তারা। ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় প্রেষণে নিযোজিত কর্মকর্তাদের। গত পাঁচ বছরে প্রকল্প সমন্বয়কারী পরিবর্তন হয়েছে চারবার। মাসখানেক আগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পথশিশুসহ ১২০ জন কর্মক্ষম ভিক্ষুককে সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা দিলেও স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি অধিদফতর। তাই তারাও ফিরে গেছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচী গ্রহণ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করাই ছিল এ কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে কর্মসূচীর ধারণাপত্র ও নীতিমালা তৈরি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। পরে ভিক্ষুকদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ২০১১ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ১০টি জোনে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ করা হয়। তবে নীতিমালায় ভিক্ষুকের সংজ্ঞা, বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক সক্ষমতা-অক্ষমতার মতো বিষয়গুলো স্পষ্ট না করায় জরিপটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। উপরন্তু, আবেদনকারী ৪০টিরও বেশি এনজিওর মধ্যে যে ১০টি এনজিও এ জরিপ পরিচালনার কাজ পায়, তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে। তাছাড়া এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থ লুটপাটের অভিযোগও ওঠে। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১২ নবেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে তিন সদস্যের উপ-কমিটি গঠন করে। মূলত তখন থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের ঢিলেমি ও অনীহা দেখা দেয়। সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জরিপকৃতদের মধ্য থেকে মাত্র ২ হাজার ভিক্ষুককে ২০১২ সালে নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকার জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সর্বাধিক ভিক্ষুক অধ্যুষিত (স্থায়ী ঠিকানা) চারটি জেলায় (ময়মনসিংহ, জামালপুর, ঢাকা ও বরিশাল) তাদের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ৩৭ ভিক্ষুকের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা মূল্যের রিক্সা অথবা ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য ৫ হাজার টাকা মূলধন দেয়ার মাধ্যমে নিজ জেলা ময়মনসিংহে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু তাদের স্থায়ী আবাসস্থল না থাকায় এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে তারা ঢাকায় ফিরে এসে বেশি লাভজনক বিবেচনায় আবারও ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়। ময়মনসিংহ জেলায় পরিচালিত পাইলট কর্মসূচীর অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মসূচীর নীতিমালা সংশোধন করে জামালপুর জেলায় স্থানীয়ভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ২৯ জনকে অভিন্ন রিক্সা/ ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ৫ হাজার টাকা মূলধন দেয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হয়নি। প্রাপ্ত উপকরণ ও মূলধন ব্যবহারের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করেছেন হাতেগোনা কয়েকজন। অন্যরা আবার ফিরে গেছেন আগের ‘পেশায়’। এদিকে ফলপ্রসূ না হওয়ায় সরকারও কর্মসূচী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতিবছর কমছে বরাদ্দের পরিমাণ। কর্মসূচী শুরুর অর্থবছর (২০১০-’১১) বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১১-’১২) এর পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয় ১০ কোটি টাকা। এরপর থেকেই বরাদ্দের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১২-’১৩ অর্থবছরে ৭ কোটি, ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে ১ কোটি ও চলতি ২০১৪-’১৫ অর্থবছরে মাত্র ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। গত অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ১ কোটি টাকার মধ্যে একটি টাকাও ব্যয় হয়নি। আর চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রাথমিকভাবে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা, হোটেল সোনারগাঁও, হোটেল রূপসী বাংলা, হোটেল র‌্যাডিসন, বেইলী রোড, কূটনৈতিক জোন ও দূতাবাস এলাকাসমূহ ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ৩১ জানুয়ারি এসব এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত হলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়া হয় প্রায় এক বছর পরে। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শুরু করতে পেরিয়ে গেছে আরও এক বছর। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলকায় পরিচালিত ওই অভিযানে নারী ও শিশুসহ আটক ১২০ জন ভিক্ষুককে রাজধানী ও টঙ্গীর সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রে তোলা হয়। তবে গত একমাসের মধ্যে ভিক্ষুকদের প্রায় সবাই এসব আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে গেছে বলে অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা শহরের একজন ভিক্ষুকের গড় দৈনিক আয় ১ হাজার টাকা। বিনা পরিশ্রমেই এ টাকা আয় হয়। আর আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মাথাপিছু দৈনিক বরাদ্দ মাত্র ৬৭ টাকা। তাই যারা একবার লজ্জা ও আত্মসম্মানের কথা ভুলে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন, তাদের এর থেকে নিবৃত্ত করা অনেক কঠিন। প্রকল্প পরিচালক ও উপ-সচিব এ কে এম ফাজলুজ্জোহা এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত করার ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। ঢাকায় এলাকাভিত্তিক অবস্থান, স্থায়ী ঠিকানায় সামাজিক মর্যাদা, ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দিষ্ট পেশা অবলম্বনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনায় রাজধানীতে বসবাসরত ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এ সমস্ত বিষয়ে যথাযথ প্রস্তুতি ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকায় চলমান কর্মসূচীতে দৃশ্যমান সাফল্য আসেনি। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পথশিশুসহ কোন মানুষকে যাতে রাজধানীতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে না হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই কর্মসূচী চালু হলে ভিক্ষুকরাও উপকৃত হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
×