ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একাডেমির সঙ্গে উদ্যানের বিচ্ছিন্নতা, দুই মেলার চেহারা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

একাডেমির সঙ্গে উদ্যানের বিচ্ছিন্নতা, দুই মেলার চেহারা

মোরসালিন মিজান ॥ বইয়ের মেলা সারা বছরই হয়। নানা নামে ছোট ছোট মেলার আয়োজন করেন প্রকাশকরা। তবে বাঙালীর প্রাণের উৎসব বলতে বোঝায় অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে। এই মেলা একটি। দু’টি কখনই নয়। কিন্তু প্রথম দশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর অদ্ভুত চেহারা পেয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫। এ পর্যায়ে মনে হচ্ছে, একই নামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি মেলা! একটি বাংলা একাডেমি চত্বরে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে অন্যটি। এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের দূরত্ব সামান্য হলেও বিচ্ছিন্নতা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে গেছে। দুই অংশের চেহারাও আলাদা। এত আলাদা যে, পাঠক কোন কোন ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থার জন্য মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিকে দায়ী করছেন প্রকাশকরা। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরারও উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। মেলা শুরুর কয়েকদিন পর থেকেই মোটামুটি উৎসবের চেহারা পায় বাংলা একাডেমি চত্বর। বহুকালের অভ্যাস মতো, পাঠক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে একাডেমি অংশে প্রবেশ করেন। মূল প্রকাশকরা বাইরে হলেও এখানে স্টলের কোন অভাব নেই। বিশেষ করে শিশু কর্নারটি সব সময়ই উৎসবমুখর। শিশুতোষ বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে নিজেদের পসরা সাজিয়েছে। বেশ কিছু স্টল। বাবা-মা, অভিভাবকদের সঙ্গে এসব স্টল ঘুরছে বাচ্চারা। বইও কিনছে। বহেরা তলায় লিটলম্যাগ। এখানে বিক্রি একটু কম। তবে সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে যে প্রাণবন্ত আড্ডা তর্ক-বিতর্ক, চলছেই। চত্বরের পুরোটাজুড়ে আছে সরকারী সংস্থা, এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল। এসব প্রতিষ্ঠানের স্টল খুব কাছাকাছি হওয়ায় একটি দেখা শেষ করে নিজের অজান্তেই অন্যটিতে চলে যাচ্ছেন পাঠক। বই দেখার পাশাপাশি কিনছেনও। আর নজরুল মঞ্চের কথা তো বলাই বাহুল্য, সারাক্ষণ এখানে চলছে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা। লেখক প্রকাশকদের এখানে গায়ে গা লেগে থাকে। মেলা মঞ্চে চলছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এভাবে হরেক আয়োজনে দারুণ জমে উঠেছে একাডেমি অংশের মেলা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি থেকে বেশ খানিকটা দূরে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। এ দূরত্ব অতিক্রম করে সেখানে প্রবেশ করলে দেখা যায় একেবারেই উল্টো দৃশ্য। এবার বিশাল পরিসর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। মূল প্রকাশকরা এখানে স্টল সাজিয়েছেন। বিপুল টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়ন গড়েছেন। কিন্তু পাঠকের উপস্থিতি আশানুরূপ হচ্ছে না। বিক্রিতে মন্দা ভাব স্পষ্ট। যেন অন্য আরেকটি মেলা! এ অংশে অধিকাংশ সময় দৃশ্যমান হচ্ছে শূন্যতা। উদ্যানের মাঝখানের বিশাল জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। এর দুই পাশে স্টল ও প্যাভিলিয়ন। এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এখানেও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা খেলা করে। পাঠকও এখানে কম আসছেন। আর যখন আসছেন তখনও ঠিক দৃশ্যমান হচ্ছেন না। বিশাল পরিসরে সামান্যই চোখে পড়ছে উপস্থিতি। ভেন্যুর বিন্যাসেও কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ছে। এর ফলে সব স্টল না ঘুরেই মেলা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন অনেক পাঠক। বিক্রিও তাই কম। এ অবস্থায় অনেক প্রকাশকই চিন্তিত। তাঁদের কেউ কেউ বাংলা একাডেমিকে এ জন্য দায়ী করছেন। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে একাডেমির কাছে কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরারও প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে ২১টির মতো অভিযোগ-অনুযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অভিযোগপত্র অনুযায়ী, একাডেমির শিশু কর্নারে স্থাপিত স্টলগুলোতে পাইরেট ও নেট বই বিক্রি হচ্ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি শিশু প্রকাশনা প্যাভিলিয়ন করার কথা থাকলেও, তা করা হয়নি। মেলায় বিক্রি কম হচ্ছে দাবি করে একাডেমির কাছে ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে। মেলার নান্দনিকতা বাড়ানো, নিরাপত্তা জোরদারসহ আরও কিছু দাবি জানানো হয়েছে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে সমিতির নেতা ওসমান গণি জনকণ্ঠকে বলেন, একাডেমির খামখেয়ালীর কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে বাকি দিনগুলো আরও খারাপ যাবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগগুলো তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি। অবশ্য সব প্রকাশক একইরকম ভাবছেন বলা যাবে না। একই প্রসঙ্গে অ্যাডর্ণ পাবলিকেশনের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ জাকির হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বিশাল পরিসর চেয়েছিলাম। পেয়েছি। প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে আসছেন। বই দেখছেন। কিনছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। বইমেলায় বই বিক্রি মুখ্য নয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, প্রকাশকদের এই জনস্রোত সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে কাজ করতে হবে। যে বই জ্ঞানের আধার সে বই দিতে হবে তাঁদের। উন্নত প্রোডাক্ট দিতে হবে। বাংলা একাডেমিতে যে ভিড় তাও খুব স্বাভাবিক বলেই ব্যাখ্যা করেন তিনি। বলেন, এটা তো ঐতিহ্য। আমাদেরকে আমাদের করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে। সারা বছরের কাজ ফেব্রুয়ারিতে এসে জমা হওয়ার কারণেও অনেক সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি। নতুন ১০৭ বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১১তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১০৭টি এবং ৬টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ মঙ্গলবার গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের নব্বইতম জন্মবর্ষ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক এমএম আকাশ, মেজর জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আলী সিকদার এবং সুভাষ সিংহ রায়। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ’৭১-এর পরাজিত শক্তি ২০১৫ সালে এসেও ষড়যন্ত্র করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সুতরাং এই সময়ে এসে নতুন করে তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি শত্রুর হাতকেই শক্তিশালী করবে এবং নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তির ঘোরে আবদ্ধ হয়ে যাবে। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বিদেশী চক্রও জড়িত ছিল। তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশকে ‘স্বনির্ভর’ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রাজনীতি বরাবরই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হীনস্বার্থের বিরুদ্ধে। অংশত সমাজতান্ত্রিক চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ তাজউদ্দীন মার্কিনীদের কুনজরে ছিলেন। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন আহমদকে ইতিহাসের আলোকে সঠিকভাবে পাঠ করলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যাবে। আলোচকবৃন্দ বলেন, জাতির কঠিনতম সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন শক্ত করে হাল না ধরলে মুক্তযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার গঠন করা সহজ হতো না। তাঁর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সাহসী পদক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয়েছিল। তাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর তাজউদ্দীনসহ জাতীয় নেতাদের জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা প্রমাণ করে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয় বরং তাঁর আদর্শের সকল অগ্রসৈনিককে হত্যা করে বাংলাদেশকে একটি পশ্চাদগামী-ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক হারুন-অর রশিদ বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য পুরুষ। এদেশের সংগ্রামী রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবহিকতায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা পর্যায়ে তাঁর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হলে নতুন প্রজন্ম গণমানুষের রাজনীতির প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নিয়ে সচেতন হবে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ছিল মোঃ সুলতান হোসেনের পরিচালনায় ‘মাটির সুর সংগীত পরিষদ’-এর পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন, আকরামুল ইসলাম, সেলিম চৌধুরী, বদিয়ার রহমান, আবদুল লতিফ সাঁই, শফিউল আলম রাজা, শিপ্রা ঘোষ, জসীম উদ্দীন সজল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার ২০১৪ ঘোষণা ॥ প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পরিচালিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার ২০১৪ লাভ করেছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকবাল হাসান এবং লেখক ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ ইকবাল। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০,০০০.০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা।
×