ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

বসন্ত আর ভালবাসা দিবসের রেশ, হঠাৎ বৃষ্টিতে বিড়ম্বনা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বসন্ত আর ভালবাসা দিবসের রেশ, হঠাৎ বৃষ্টিতে বিড়ম্বনা

ঋতুরাজ বসন্ত শুরুর দিন। ভালবাসার বিশেষ দিবস। শুক্র ও শনিবার তাই দারুণ জমে উঠেছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান ছিল লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন বয়সী মানুষ বইয়ের সঙ্গেই বসন্ত উদ্যাপন করেছেন। ভালবাসা দিবসেও বই ছিল। আর তার পর রবিবার। হ্যাঁ, যথারীতি কমেছে পাঠক উপস্থিতি। টানা দুই দিনের ঘুরে বেড়ানোর ক্লান্তি আর হরতালের ফলে মেলায় ভিড় কমেছে। তবে যারা গত দুই দিন বাসা থেকে বের হননি, যাদের ভিড় অপছন্দ, তারা এসেছিলেন রবিবার। কারও পোশাকে বাসন্তী রং। কেউ সেজে এসেছিলেন ভালবাসার লালে। ফলে বিশেষ দিবস দুটির রেশ এদিনও ছিল। বিভিন্ন জুটি দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা ঠিক বই কিনতে আসেননি। এসেছেন বেড়াতে। মোবাইল ফোনে ছবি তুলে, বেঞ্চে বসে গল্প করে খালি হাতেই বের হয়ে গেছে এই অংশটি। তবে বইপোকাদের জন্য দিনটি স্বস্তির ছিল। তাঁরা কেনায় ব্যস্ত ছিলেন। সাজ্জাদ হুসেন নামের এক তরুণ দু’ হাত ভরে বই কিনে ফিরছিলেন। জানালেন, প্রথম দিকে অনেক বই মেলায় এসে পৌঁছে না। এখন মাঝামাঝি সময়। অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নতুন বই চলে এসেছে। এ কারণেই আজকে আসা। আবার শেষ সপ্তাহে বই কিনতে আসবেন বলে জানান তিনি। এদিকে, মেলায় রবিবার পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমির স্টলে মোট বিক্রি হয়েছে ৫৭,৬৬,০৯৭ টাকার বই। শেষ রাতে বৃষ্টিতে বইয়ের ক্ষতি ॥ রবিবার গভীর রাতে হঠাৎ করেই নেমে পড়েছিল বৃষ্টি। অল্পস্বল্প নয়। ভারি বর্ষণ। লম্বা সময়। ফলে কিছু কিছু স্টলের নিচে পানি জমে যায়। ফলাফলÑ অনেক বই ক্ষতিগ্রস্ত। রবিবার মেলায় প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়ে জলে ভেজা বই। বিভিন্ন স্টলের সামনে এসব বই শুকাতে দেন প্রকাশকরা। র‌্যামন পাবলিশার্স, অন্যপ্রকাশ, সূচিপত্র, আহমেদ পাবলিশার্স, রয়েল পাবলিশার্সসহ বেশ কয়েকটি স্টল বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম জানান, সব যেভাবে চলছি তাতে বৃষ্টির কথা ভাবনাতেও আসেনি। আমাদের স্টলে প্রচুর বই ছিল। মেঝের কাছাকাছি জায়গায় রাখা বেশ কিছু বই আটকে থাকা পানিতে ভিজে গেছে। এ কারণে স্টল এক ঘণ্টা দেরিতে খোলা হয়। ৭১ নতুন বই ॥ রবিবার বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমাপড়া নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল ৭১। এগুলোর মধ্যে গল্প ৭টি, উপন্যাস ১১টি, প্রবন্ধ ৭টি, কবিতা ১৫টি, গবেষণা ৫টি, ছড়া ২টি, শিশুতোষ ৩টি, জীবনী ৪টি, বিজ্ঞান ১টি, ভ্রমণ ৩টি, অনুবাদ ২টি ও অন্যান্য বিষয়ে রচিত ১১টি বই রয়েছে। এদিন অনন্যা থেকে এসেছে লুৎফর রহমান রিটনের ‘হরিণ একটা বান্ধা ছিল গাছেরই তলায়’, ফজলুল আলমের ‘দেহ সুখ’ ও ‘সংস্কৃতির যত শত্রু’। বিজয় প্রকাশ থেকে এসেছে মোস্তফা সোহেলের ‘ভালোবাসা ও একটি জল ফড়িং’, তারিক সজিবের ‘তুমি আমারই ছিলে’। ঐতিহ্য থেকে এসেছে জুরজি জায়দানের ‘শাজারাতুর দুর’। নির্বাচিত বই ॥ একাডেমিক প্রেস এ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি থেকে এসেছে মুস্তফা চৌধুরীর বই ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস’। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে ২০ বছরের মতো কাজ করেছেন লেখক। তার নির্যাস এই গ্রন্থ। অনেকেরই জানা, ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই ফ্যামেলিজ ফর চিলড্রেন নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে ১৫ যুদ্ধশিশুকে লালন পালনের জন্য কানাডায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ মেয়ে ও ৭ ছেলে শিশুকে সে দেশের বিভিন্ন পরিবার দত্তক নেয়। তবে এই শিশুরা ঠিক কার ঘরে, কিভাবে বেড়ে উঠেছে, বর্তমানে কে কি করছেনÑ এসব তথ্য কারও তেমন জানা নেই। তথ্যগুলো সংগ্রহ করে বইয়ে যুক্ত করেছেন লেখক। এবারের মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আলোকচিত্রে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর রণাঙ্গন’। আলোকচিত্রনির্ভর প্রকাশনায় রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালে সারা দেশের মতো উত্তরাঞ্চলের রণাঙ্গনেও জীবন দিয়েছেন বীর সেনারা। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে লড়ে শহীদ হয়েছেন। বর্বর বাহিনী সাধারণ নিরীহ মানুষকেও হত্যা করেছে। তাঁদের স্থান হয়েছে বধ্যভূমিতে। যুদ্ধের স্থান, বধ্যভূমি, স্মৃতিস্তম্ভসহ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্মারকের আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে এ্যালবাম। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্ত করা হয়েছে নাতিদীর্ঘ আলোচনা। স্বল্প পরিসরে উত্তরাঞ্চলের সকল জেলাকে উপস্থাপন করা সম্ভব না হলেও এ্যালবামটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। রংপুর অঞ্চলের সদর দফতর ৬৬ পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া সদরদফতরের সার্বিক পরিকল্পনা সহায়তায় এ্যালবামটি প্রকাশ করেছে বিডিএস’৭১। সরব নজরুল মঞ্চ ॥ মদিনা জাহান রিমির ‘ইনসমনিয়া’ ও ‘দেড়শ মাইল দূরের স্বর্গ’ এবং শাহরিয়ার হোসেনের ‘শেষ অধ্যায়’সহ ১০টি নতুন বইয়ের মোড়ক উšে§াচন করা হয় নজরুল মঞ্চে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ রবিবার বিকেলে মেলামঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ‘অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিশাত জাহান রানা এবং মৃত্তিকা সহিতা। অধ্যাপক শামসুল হোসাইনের অনুপস্থিতিতে তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলা একাডেমির সহপরিচালক সায়েরা হাবীব। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মাহ্মুদ শাহ কোরেশী। প্রাবন্ধিক বলেন, যে আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো ধারণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে সেগুলোর মধ্যে ছিল উদার জাতীয়তাবাদ, সুস্থ আন্তর্জাতিকতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার শ্রেণীবৈষম্য ও শোষণের অবসান। এই আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোর বিকাশে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে সালাহউদ্দীন আহমদ কলম ধরেছিলেন নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে আবেগ-অনুভূতিগুলো বাঙালীদের মনে ও হৃদয়ে বিশেষ অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেছিল সেগুলোর লালন ও পরিচর্যার চেষ্টায় তিনি সর্বদা যতœবান ছিলেন। তিনি বলেন, ইতিহাসের লিখিত পরিসরের পাশাপাশি কথ্য ইতিহাস নিয়ে বিশেষ চর্চা তাঁর ইতিহাস বিষয়ে সর্বতোমুখী দৃষ্টিরই পরিচায়ক। আলোচকরা বলেন, বিনয়-উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা ছিল সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের স্বভাবধর্ম কিন্তু এর অভ্যন্তরে সক্রিয় ছিল তাঁর দৃঢ় আদর্শবাদ। তিনি বস্তুগত উন্নতিকে মানুষের জন্য পরম ভাবেননি বরং সভ্যতার অগ্রগমনকে মানুষের যথার্থ অগ্রগতি বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি আমৃত্যু ভেবেছেন, মানুষের মুক্তির জন্য সমাজকে হতে হবে ইহজাগতিক আর রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ইতিহাসের মধ্যে থেকে ইতিহাসকে বদলানোর সাধনাই হবে আমাদের জন্য সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের যথার্থ শিক্ষা। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশী বলেন, সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের জীবনে সুরুচি, গভীর বিদ্যাবত্তা এবং প্রগাঢ় ইতিহাসবোধের অত্যুচ্চ প্রকাশ ঘটেছিল। তিনি ইতিহাসের ভেতর ভবিষ্যতের পথচলার ভাবসার সংগ্রহ করতে তৎপর ছিলেন। তাঁকে মূল্যায়নে আমাদের আরও অন্তর্ভেদী গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া আহমেদ ও মুস্তাফা ওয়ালিদ। সংগীত পরিবেশন করেন সাইদুর রহমান বয়াতী, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, সোনিয়া বয়াতি, পাগলা বাবলু, মমতা দাসী বাউল, রণজিৎ দাস বাউল, কোহিনুর আকতার গোলাপী ও আমজাদ দেওয়ান। এছাড়াও ছিল ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’র পরিবেশনা। আজকের আয়োজন ॥ আজ সোমবার বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমেদ রেজা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, রশিদ আশকারী এবং মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী।
×