ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে একাদশ শতাব্দীতে সেন রাজাদের রাজত্বকালে। তখন বাংলাভাষা এক ভয়ানক সঙ্কট ও অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ সময় বাংলার বৌদ্ধশাসন উৎখাত করে সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা বাংলাভাষা চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলাভাষার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত ও ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছিলেন, “ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দুর দুর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধীজনের অপাঙ্কতেয় ছিল, তেমনি ঘৃণার, অনাদরের ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।” ভাষা আন্দোলন গবেষক মোহাম্মদ আমীন লিখেছেন, দেড় হাজার বছর আগে প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলাভাষা জন্ম নেয়ার পর বাংলার কবি এবং গায়েনরা বাংলাভাষায় কবিতা, গান গেয়ে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ কথাবার্তার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে প্রসারের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। শিশু ভাষাটি যখন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছিল তখনই সেন রাজবংশ বাংলাভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমআর মাহবুব ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে এমন তথ্য উল্লেখ করেন। তার ওই গ্রন্থে বলা হয়েছে, ষোলো ও সতেরো শতকে বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ও বেসরকারীভাবে ব্যবহৃত হতো। সেই থেকে বাংলাভাষা প্রথম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ভাষাবিজ্ঞানী ড. এসএম লুৎফর রহমান এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা সরকারী কাজে তার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তার নির্দিষ্ট তারিখ জানান না দেয়া গেলেও, এ তরফে সব নমুনা-নিশানা করা গিয়েছে।’ তা থেকে দেখা যায়- সতেরো শতকের পয়লা দশক থেকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি ও সরকারী ব্যবহার ঘটে চলেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত দেন একজন ব্রিটিশ লেখক ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হলহেড। বাংলার ১৭৭৮ সালে তার বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটিতে। হলহেডের বাংলা হরফে মুদ্রিত এটিই প্রথম বাংলা গ্রন্থ। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাভাষার ওপর আঘাত নেমে এলেও কোনকালেও বাংলাভাষাকে শিকলে আটকে রাখতে পারেনি। ১৯৫২ সালেও পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীও বাংলাভাষার হাতে-পায়ে শিকল পরাতে পারেনি। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় ভারত বিভাগের আগে থেকেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। সেই সময় পূর্ববাংলার চীফ মিনিস্টারের কাছে বুদ্ধিজীবীরা একটি স্মারকলিপি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খান ও কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী পাল্টা বাংলাভাষার প্রস্তাব দেন। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসে ‘গণআজাদী লীগ’ (পরবর্তীতে সিভিল লিবার্টি লীগ)-এর পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তৃতীয় খ-) গ্রন্থে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তানে বাংলাভাষার সম্ভাবনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী এবং জনমত প্রকাশ করতে থাকে। তন্মধ্যে ১৯৪৮ সালে ২২ জুন দৈনিক ইত্তিহাদে প্রকাশিত আবদুল হকের কলাম ছিল প্রথম। ২৯ জুলাই মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নিবন্ধটি ছিল বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এসব নিবন্ধের অধিকাংশের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দেয়া প্রসঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ এর একটি সভায় একই দাবি উত্থাপিত হয়।
×