ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

একজন সামরিক অফিসার, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার। তিনি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। খেতাবও পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সমস্তটা সময় পাক আর্মির হেফাজতে অত্যন্ত আদর-যত্নের সঙ্গে সামরিক ছাউনির মধ্যে থেকেছেন। তাঁর সন্তানরাও তাঁরই সঙ্গে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। উপরন্তু সামরিক ছাউনিতে থাকার কারণে হয়তবা পাকিস্তানী সেনাদের উন্মাদনা, তাদের তথাকথিত শত্রু দমনে বীরত্বের পরিচয় পেয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন। ভেবেছেন যাক, বাংলাদেশে থেকেও তাঁদের নিরাপত্তার তো কোন ভয় নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন নিশ্চিতভাবে আর কোন পরিবার থাকতে পেরেছেন? স্বাভাবিকভাবে এদের পাকসেনা তথা পাকিস্তানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই স্বাভাবিক। এই সামরিক কর্মকর্তা পরবর্তীকালে পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তার বহু প্রমাণ আছে। এটা তো ঠিক তিনি জানতেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং হত্যার পর তিনি তরতর করে দেশের দ-মু-ের কর্তা হয়ে বসলেন। তাঁর মতো লাভবান আর কেউ হয়নি। প্রধান সামরিক কর্মকর্তার পদ আলোকিত করলেন এবং পাকিস্তান আমলের প্রধান সেনাকর্তা আইয়ুব খানের মতো প্রহসনের নির্বাচন করে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্কন্ধে সিন্দবাদের বুড়োর মতো চেপে বসলেন। প্রধানমন্ত্রী করলেন রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে, কুখ্যাত নরপিশাচ রাজাকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিলেন। এই চতুর মানুষটি ছাত্রদের ছাত্রত্ব নষ্ট করার অপকৌশল প্রয়োগ করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের যেভাবে চরিত্র হননের দ্বারা ধ্বংসের পথে চালিত করেছিলেন তা বাংলাদেশে আর কোন শাসক পারেননি। এমনকি পাকিস্তান আমলে মোনায়েম সরকারও সেভাবে এনএসএফকে দাঁড় করাতে পারেননি। যে কোন অপকর্ম করতে হলে প্রথমত অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি অবলীলায় অহঙ্কারের সঙ্গে বলতেন “Money is no Problem” সংবিধান থেকে মুুক্তিযুদ্ধের মূল যে সুর ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে দিলেন এবং স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তিনি তা পুনর্প্রবর্তন করলেন। যে ‘মূলধারাকে’ আশ্রয় করে এ দেশের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার শিকড়টা কেটে ফেলার চেষ্টায় ব্রতী হলেন। পৃথিবীর জঘন্য এবং নিকৃষ্টতম আইন ‘ইনডেমনিটি আইন’ সংসদে পাস করালেন। এই আইনেরবলে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল সেই খুনীদের কারও বিচার হতে পারবে না। নিজেকে সংস্কৃতিমনা প্রমাণ করতে ‘থিয়েটারের’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ দেখেছিলেন। নাটকের পরে মঞ্চে উঠে সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নাটকের প্রশংসাও করেছিলেন। তবে তাঁর মতো এত বড় অভিনেতা নাটকের কলাকুশলীরা হতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্মের ১০ বছরের মধ্যে তিনি একেবারে পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে দেশকে নিয়ে এসেছিলেন। শাবাশ বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘বীরউত্তম’। মরহুম জিয়াউর রহমান বিরাট এক তর্কের অবতারণা করলেন আমরা বাংলাদেশী না বাঙালী। রাজনীতি কাকে বলে এবং কিভাবে তা প্রয়োগ করা যায় তা তাঁর সময়ে আমরা দেখেছি। জিয়ার উত্তরসূরিরা রাজনৈতিক আন্দোলনের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটকে সভা-সমিতি করতে দেয়া হচ্ছে না, তাদের দলীয় নেতাদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে, সুতরাং তারা গণতান্ত্রিক দেশে জনতাকে নিয়ে আন্দোলনে নামতেই পারে। এমন আন্দোলনে আমাদের প্রজন্মের যে অভিজ্ঞতা তাতে অনায়াসে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সঠিক সংজ্ঞা স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার। কিন্তু আন্দোলনের ডাক দিয়ে দলের নেতাকর্মীসহ সকলে গর্তের মধ্যে ঢুকে থাকবে আর ভাড়া করা লোক দিয়ে পেট্রোলবোমা মেরে নির্দ্বিধায় অতি, অতি সাধারণ মানুষকে নৃৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারবে, এটা কখনই রাজনৈতিক আন্দোলনের আওতায় আসতে পারে না। এখন বুদ্ধিজীবীরা দলীয় পরিচিতি লাভ করেছেন। তাতে তাঁদের লজ্জাশরমের বালাই নেই। প্রতিদিন অনবরত টেলিভিশনে টকশোতে দু’দলের বুদ্ধিজীবীরা তর্কে অবতীর্ণ হন এবং শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতভাবে তা শেষ হয়। শাবাশ বিএনপি স্র্রষ্টা জিয়াউর রহমান সত্যি রাজনীতির সংজ্ঞা তাঁর উত্তরসূরিরা বদলে দিয়েছেন। দীর্ঘ দেড় মাস অকারণে মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছে। পরিবারের সদস্যরা যতক্ষণ বাইরে থাকে ঘরের মানুষের স্নায়ু একেবারে সপ্তমে চড়ে বসে। এত মানসিক চাপ নিয়ে বাঁচার কষ্ট আর বহন করা যাচ্ছে না। অথচ রাজনৈতিক অধিকারের দোহাই দিয়েই এ সমস্ত সন্ত্রাসী কাজ চলছে। আর কতদিন চলবে জানি না। আর কত উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হবে। সেদিন টিভির একটি টকশোতে এক প-িত বক্তা অবলীলায় বললেন, পশ্চিম বাংলায় ‘নকশাল’ আন্দোলনের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের অবস্থা তুলনা করা যায়। সেই মূর্খ প-িতকে বলি, নকশাল আন্দোলনের পথ ভুল হতে পারে, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রীরা দেশের সাধারণ বঞ্চিত মানুষের কথা ভেবে তারা ঊংঃধনষরংযসবহঃ-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। কত তাজা প্রাণ যে বলি দিতে হয়েছে তার জন্য। ব্রিটিশ আমলেও তো এদেশের তরুণরা ব্রিটিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছেন, কত তরতাজা যুবক ফাঁসির রজ্জুতে প্রাণ দিয়েছেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য।’ দেশকে ভালবেসে আমরাও তো পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন টাকার বিনিময়ে কিছু সন্ত্রাসী অতি সাধারণ মানুষকে হত্যা করার ব্রত নিয়েছে। রাজনীতির এ কি করুণ পরিণতি! দেশের এ সঙ্কটের সময় দুই দল তথা দুই নেত্রী পরস্পরের দিকে পেছন ফিরে আছেন। যেন একে অপরের মুখ দেখাও পাপ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির আদর্শের সাংঘর্ষিকতা আছে আমাদের মানতে হবে। আওয়ামী লীগ তার তিনবার ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার এবং তা কার্যকরী করেছে। জাতি ঋণমুক্ত হয়েছে এবং সভ্য বলে পরিচিতি লাভ করেছে। ’৭৫ থেকে ’৯৬ এই দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে শাসকদের কাছ থেকে তার বিন্দুমাত্র আভাস পাওয়া যায়নি। উপরন্তু বিভ্রান্তিমূলক ইতিহাসের মধ্যে একটা গোটা প্রজন্ম গড়ে উঠেছে ’৯০-এর গণজাগরণে এরশাদের পতনের পর বিএনপি রাজত্বকালে ভুল ইতিহাস প্রচার করে। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কথা দেশবাসীর কাছে উন্মুক্ত করে। কিন্তু বেদনার বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের খ-িত চিত্র তাতে উঠে আসে। এখন সকলের মনে প্রশ্নÑ দেশের এই চরম অরাজকতার শেষ কোথায়। দু’পক্ষের জেদাজেদিতে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু সরকারকে তো জনগণের কথা ভাবতে হবে। সমস্যার তো একটা সমাধান করতে হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পারস্পরিক যে মানসিক দূরত্ব সেখানে দু’জনের এক টেবিলে বসা তো প্রায় অসম্ভব। সরকারপ্রধান এবং বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে সামান্য সৌজন্যবোধটুকুও নেই। খালেদা জিয়ার পুত্রের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাড়ির দরজার কাছ থেকে ফিরে এলেন। তাঁকে বসতে পর্যন্ত দেয়া হলো না। এদিকে খালেদা জিয়া অবরোধ-হরতাল বন্ধ করছেন না বলে তাঁর বাড়ির বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। তাঁর গড়নরষব, রহঃবৎহবঃ সব বিচ্ছিন্ন করা হলো। এটা কোন গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে? এরকম বালখিল্যসুলভ আচরণ করার অর্থ কি? সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা এমন খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করে নিজের পায়ে কুড়াল মারল। এত অবিশ্বাস, এত আস্থাহীনতা নিয়ে কি সংলাপে বসা যায়? তাছাড়া বিএনপি যে আবদার করছে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে এবং তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেটা তো হয় না। কারণ সেটা আইনত সম্ভব নয়। গত এক বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশ খুব সাবলীলভাবে চালিয়েছে। সাধারণ মানুষের মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। বিএনপির ডাকা অবরোধে যদি ঢাকার চারদিকে পাঁচ লাখ মানুষও একসঙ্গে হয়ে শহরকে অবরুদ্ধ করতে পারত তাহলেও প্রমাণিত হতো যে, জনগণ এ সরকারকে চায় না। জনগণ, একমাত্র জনগণই ইতিহাসের গতিধারা সঠিক পথে বয়ে নিতে পারে। এ দেশে যুবক সমাজকে আহ্বান জানাচ্ছিÑ এত মূল্য দিয়ে দেশটা গড়ে উঠেছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার পথটা বেছে নিন। অনেক প্রতিকূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক দল প্রতিনিয়ত পাশাপাশি চলে সঠিক পথ দেখিয়েছে, তারাও আবার একতাবদ্ধ হোক। দেশ বাঁচুক। ‘সবার ওপরে যে মানুষ সত্য’ তা প্রমাণিত হোক।
×