ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাসুদা ভাট্টি

এরপর কার জন্য রাজনীতি করবেন তারা?

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

এরপর কার জন্য রাজনীতি করবেন তারা?

রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বড্ড গোলমেলে এবং একথা সর্বাংশেই সত্যি যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছুই নেই। কেন হঠাৎ এই উপলব্ধি বা নতুন করে এই সত্য বুঝতে পারা, তা একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব আজ। প্রায় দু’মাস হতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার মতো বর্বরতা কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতেই ঘটছে এবং তা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে আরও বর্বরতম উগ্রবাদী সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট), তারা দিনকয়েক আগে একসঙ্গে ৫০ জন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি জানি না, রাজনীতি আসলে কার জন্য? যদি মানুষের জন্যই হয়ে থাকে তাহলে মানুষকে পুড়িয়ে মেরে, আতঙ্কিত করে ক্ষমতা লাভের এই প্রক্রিয়াকে কোন রাজনৈতিক দর্শন দিয়েই কি বিশ্লেষণ করা যায়? যায় না। এমনকি, শান্তি ও সংঘাতের কোন সূত্রেই একথা এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি যে, কোন অধিকার আদায়ের জন্য কোনভাবেই সন্ত্রাসকে এভাবে ব্যবহার করা যায়। অধিকার আদায়ের বহু মত ও পথ রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদ এবং এ্যাক্টিভিস্টগণ বহু বই লিখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু কেউই কোথাও মানুষকে হত্যা করে মানুষের জন্য অধিকার আদায়ের কোন পথের কথা উল্লেখ করেননি কিংবা সমর্থনও করেননি। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখছি বিপরীত চিত্র। এখানে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যাকে জায়েজ করে দিচ্ছেন দেশের বিবেক বলে পরিচিত মুখগুলো। এতে তাঁদের কী লাভ? লাভ একটাই, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। বিগত সপ্তাহে এ বিষয়ে লিখেছিলাম। একজন পাঠক লিখেছেন, আপনি কেবল আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরোধিতাকারীদের কথা লিখেছেন, কিন্তু কেন তাঁরা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেন, সে বিষয়টি উল্লেখ করেননি; এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করবেন কি? আসলে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার কারণ নানাবিধ হতে পারে। প্রথমত, দলটি সবচেয়ে পুরনো এবং এর গণভিত্তি ঈর্ষণীয়। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পুরনো শত্রুদের কাছে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য দোষী। সুতরাং তাঁদের পক্ষে যাঁরা এখনও বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা মূলত পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাস করেন, ফলে আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন। কিন্তু অনেকেই রয়েছেন যাঁরা কোনভাবেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারী নন অথচ আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন। তাঁরা কেন করেন? আমার বিশ্বাস তাঁরা এ কারণে করেন যে, দীর্ঘকাল রাজনীতি করেও তাঁরা আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ এমপির জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির যে গ্রহণযোগ্যতা তা তাঁরা কোনদিনই অর্জন করতে পারবেন না, ফলে তাঁরা প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে থাকেন। কিন্তু বিএনপিকে কেন তাঁরা আপন মনে করেন? কারণ, আওয়ামী লীগকে আঘাত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে বড় অস্ত্র তাঁদের হাতে আর নেই। এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও, বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীর সঙ্গে যখন অর্থ খরচ করে একজন তৃতীয় ও নিরপেক্ষ (প্রায়শই বামদলভুক্ত) প্রার্থীকে দাঁড় করানো হয় তখন সেই প্রার্থী মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থীরই ভোট নষ্ট করেন এবং তাতে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরই লাভ হয় ষোলো আনা। ফলাফল বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। এই হিসাব তাঁরা জানেন বলেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে কস্মিনকালেও যাঁদের মিল হওয়ার কথা নয়, আপাতভাবে যাঁদের চেহারা আমরা চিনি বা টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা যাঁদের আদর্শিক বুলি শুনে থাকি তাঁরা গোপনে এবং ইদানীং প্রকাশ্যেই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির অন্যতম সমর্থক ও প্রায়শই মুখপাত্রের ভূমিকাটি গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এ বড় ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত। দ্বিতীয়ত, এই দলভুক্তগণ কেন শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন না তা বিস্তারিত বলার জন্য একটি স্বতন্ত্র লেখা লিখতে হবে। সংক্ষেপে একথাটিই বলতে চাই যে, শেখ হাসিনা প্রথমত আওয়ামী লীগের প্রধান, দ্বিতীয়ত তিনি একজন মহিলা, তিনি কেবল গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বসে থাকেন না, তিনি রাজনীতি বোঝেন, সেই অনুযায়ী পাল্টা চাল দিতে সমানভাবে পারদর্শী, আন্তর্জাতিকভাবে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে যায় এমন অনেক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সর্বশেষ তিনি ঠোঁটকাটা, একগুঁয়ে ও জনপ্রিয়। সুতরাং, একজন নারী হিসেবে তাঁর এত গুণ থাকাটা দেশের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় বড় হওয়া বেশিরভাগ রাজনীতিবিদের কাছেই বিরাট বোঝার মতো, সুতরাং তাঁরা শেখ হাসিনাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের কাছে শেখ হাসিনার বিপরীতে অন্য যে কোন রাজনীতিবিদই গ্রহণযোগ্য, কেবল শেখ হাসিনা নন। এই দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ছিল। শেখ হাসিনা তাই এই বিরোধিতা অর্জন করেছেন পৈত্রিক সূত্রেই। বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের বিরোধিতা করেছেন এমন নজির বহু রয়েছে। রাজনীতিতে তাঁর উত্থান এবং ক্রমশ জাতির পিতা হয়ে ওঠাটা যাঁরা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা তাঁর বিরোধিতা করতে করতে আজকে শেখ হাসিনার বিরোধিতাও করেন এবং দেশের ধর্মবাদী ও সন্ত্রাসী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। অনেকে তো শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী হতে হতে রাজনৈতিক ভাঁড় ও পাগল পর্যন্ত হয়েছেন। যাক, মূল প্রসঙ্গে ফিরি। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের জন্মের পর জন্মেছি তাঁরা বড় হয়েছি দেশের পরিচিত ব্যক্তিদের স্খলন আর পতন দেখতে দেখতে। আমাদের প্রজন্মের জন্য এটা বড়ই দুর্ভাগ্যের। কারণ, জাতীয় চরিত্র ও বিবেকের পতন দেখাটা খুব সুখকর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বিগত দুই মাস ধরে চলা পেট্রোলবোমা-সহিংসতা যেন এই পতিত ও স্খলিত জাতীয় ব্যক্তিত্বদের একেবারে পচিয়ে ফেলছে। কারণ, তাঁরা ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের বিপরীত শিবিরে অবস্থান নিয়েছেন। একজন সাধারণ মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, বলুন তো কেন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিকে আপনি সমর্থন দিচ্ছেন না? যাঁর সামান্য বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে তাঁর উত্তর কী হতে পারে? তিনি নিশ্চিতভাবেই বলবেন যে, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির যতই যৌক্তিকতা থাকুক না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যতই তাঁদের সঙ্গে একমত হই না কেন, আমাকে কিংবা আমার সন্তানকে পুড়িয়ে মেরে তাঁরা সে যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না; আমি নিজেই যদি না বাঁচি তবে আমার পোড়া লাশ নিয়ে রাজনীতি হলো কি হলো না, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যেতে পারল কি পারল না, তাতে আমার কী এসে যায়? সুতরাং, আমি এই অগ্নিউৎসবের রাজনীতির অংশ হতে চাই না। খুব সাফ জবাব। ওপরের কথাগুলো কেবল আমার জবানিতে আমি লিখেছি, কিন্তু বিগত মাসাধিককাল ধরে চলা টেলিভিশনে ও খবরের কাগজে সাধারণ মানুষের বক্তব্য থেকেই কথাগুলো সংগ্রহ করেছি, বানিয়ে কিছুই লিখিনি। সুতরাং, বিএনপি-জামায়াতের এই আগুনে পোড়ানোর রাজনীতিতে সমর্থন, সহযোগিতা এবং টেলিভিশন টকশোয় মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে যাঁরা জাতীয় বিবেক থেকে ক্রমশ জাতীয় ভিলেনের চরিত্রে নেমে আসছেন তাঁরা কি কখনও একবারও ভেবে দেখেছেন যে, শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কি দাঁড়াবে? তাঁরা নিশ্চয়ই অনেক হিসাব কষেই রাজনীতির এই ধারাটি বেছে নিয়েছেন। ধরুন, আজকাল যেসব টেলিফোনালাপের টেপ প্রচারিত হচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ে এগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানানোটাই সঠিক কাজ হতো। কারণ, জনগণের কথোপকথন রেকর্ড করার মধ্যে কোন বীরত্ব বা যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। বরং, বাক্্ স্বাধীনতার ওপর এই হস্তক্ষেপকে নিন্দা জানানোর ভাষা নেই আমার। কিন্তু যে সকল কথাবার্তা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার কোনটিই কি দেশের জন্য, দেশের রাজনীতির জন্য, অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক? কেউ নির্দেশ দিচ্ছেন পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করার, কেউ বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর হত্যাকা- ঘটাতে হবে, নইলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হবে না, কেউ বলছেন সেনা হস্তক্ষেপে তিনি নিজেই ভূমিকা রাখতে চান- এর কোনটিই কি দেশের জন্য, দশের জন্য উপকারী? আমরা যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি তাতে এ ধরনের নির্দেশদাতা, হুমকিদাতা এবং নষ্ট মানুষের চেহারা জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়াটা কি অপ্রয়োজনীয়? এসব প্রশ্নের হিসাব মেলানো আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মানুষের স্বাভাবিক সকল অধিকারের পক্ষে, কিন্তু সেই অধিকারের অপব্যবহার করে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলা, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করার সমর্থক কোনভাবেই নই, তা সে যে দল, ব্যক্তি যত বড় রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যই করে থাকুন না কেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যা সমর্থন দেয়া সম্ভবপর ছিল তা একটি স্বাধীন দেশে কোন সাংবিধানিক সরকার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে দেয়া যে অসম্ভব তা বিশ্লেষণ করে বলার প্রয়োজন দেখি না। আজকে যাঁরা রাজনীতির হিসাবকে গোলমেলে করে দিচ্ছেন, ক্রমশ পতিত থেকে পচে যাচ্ছেন, একে একে উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছেন জাতির সামনে, যাঁরা মনে করছেন যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে আসলেই কিছু নেই, তাঁরা নিশ্চয়ই বড় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের আব্রু যে ক্রমশই খুলে যাচ্ছে জনসম্মুখে তা কি তাঁরা টের পাচ্ছেন? এরপরও তাঁরা হয়ত জনগণের অধিকারের কথা বলে প্রেসক্লাব থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার সাহস রাখেন, এটা বাংলাদেশ বলেই। নইলে এই ভয়ঙ্কর অসুস্থ ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির জন্য তাঁদের শ্রীঘরে থাকার কথা থাকলেও তাঁরা এখনও সরকার হটানোর কাজটাই করে যাচ্ছেন। এরপরও যদি কেউ মনে করেন যে, দেশে গণতন্ত্র নেই, শেখ হাসিনা একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন, তাঁরা হয় মিথ্যেবাদী, নয় চোখ ও বিবেক বন্ধক দিয়ে এসেছেন কোন রাজনীতির মহাজনের কাছে, যাঁদের মানুষের মাংসেও অরুচি নেই। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ [email protected]
×