ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কলাপাড়ায় সাগরে মারা পড়ছে নোনা পানির পোনা

বাগদার রেণু আহরণ চলছে

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাগদার রেণু আহরণ চলছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৩ ফেব্রুয়ারি ॥ কলাপাড়ার উপকূলীয় সাগর ও নদীতে বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা আহরণের মহোৎসব চলছে। আর এ মহোৎসবে চিংড়ির রেনু পোনার সঙ্গে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ মারা যাচ্ছে। ফ্রি-স্টাইলে অন্তত অর্ধশত স্পটে সূক্ষ্ম ফাঁসের মশারি নেটের হাজার হাজার বেহুন্দি ও বক্স আকৃতির জাল পেতে পোনা মাছ নিধনের ভয়াবহ তা-ব চলছে। প্রতিদিন শুধু কলাপাড়ার উপকূলীয় নদী ও সাগরবক্ষে কোটি কোটি পোনা নিধন হচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ, মৎস্য বিভাগ, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডসহ সকলের নাকের ডগায় চলছে মৎস্যসম্পদ নিধনের এমন তা-ব। পোনা ধরা নিষেধ-এমন প্রচার চালিয়ে আবার আড়ত মালিকরা আহরণকারী দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে নোনা পানির পোনা কিনছে পানির দরে। মাত্র সর্বোচ্চ ৪০ টাকায় এক শ’ রেনু পোনা বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে গরিব এ জনগোষ্ঠী। মোট কথা যে যেভাবে পারছে কৌশলে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু দেশ হারাচ্ছে মাছের বিশাল ভা-ার। সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের খাজুরা থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত অন্তত দশ হাজার মশারি নেটের বানানো জাল পাতা রয়েছে। সাগর কিংবা নদীর পাড় থেকে আড়াআড়ি খুঁটা গেড়ে একটি দড়ির সঙ্গে অন্তত কুড়িটি বেহুন্দি জাল পেতে রাখা হয়েছে। মাইলের পর মাইল জুড়ে ৫০ থেকে এক শ’ হাত পর পর হাজার হাজার জাল পাতা রয়েছে। কুড়িটি বেহুন্দি ছোট্ট নেটে অন্তত একেক বারে দুই-তিন শ’ বাগদার রেনু ধরা পড়ছে। আর এ রেনু উপকূলে বসে গণনার কারণে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের কোটি কোটি পোনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেখার কেউ নেই। রামনাবাদ নদীর শেষ প্রান্তে সাগর মোহনা চরধুলাসার সৈকতে অন্তত পাঁচ শ’ জাল পাতা রয়েছে। সারি সারি করে দুই-তিন শ’ গজ নদীর মধ্যে খুঁটা গেড়ে ২০-২৫টি ছোট সাইজের বেহুন্দি মশারি নেট পাতা হয়েছে। কতক্ষণ পর পর জেলেরা জাল থেকে রেনু পোনা গামলা কিংবা অন্য পাত্রে এনে বেলাভূমে বাগদার রেনু বাছাই করে বালুতেই অন্য প্রজাতির পোনাসহ সব ফেলে দেয়। পানির পাত্রে সংরক্ষণ করায় মারা পড়ছে না বাগদার রেনু পোনা। কিন্তু অন্যসব পোনা মরে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যেই। এদেরই একজন শাহীন। কুড়িটি জালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্তত ৭০০ বাগদার রেনু পোনা পেয়েছেন। এজন্য অন্য প্রজাতির সাদা মাছের রেনু পোনা মারা গেছে কমপক্ষে ৪৯ হাজার। একেকটি বাগদার রেনু শিকার করতে গড়ে অন্য প্রজাতির পোনা মারা পড়ছে ৭০-৭২টি। একটি উন্নয়ন সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য এটি। গুনেও পাওয়া গেছে একই পরিসংখ্যান। এভাবে গোটা উপকূলে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ মেরে ফেলা হচ্ছে। বাগদার রেনু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ-এমন অজুহাত দেখিয়ে আহরণকারী গরিব মানুষের কাছ মাত্র ৩৫-৪০ টাকায় এক শ’ বাগদার রেনু পোনা কেনা হচ্ছে। অথচ আড়ত মালিকরা এক শ’ রেনু পোনা বিক্রি করছে ৭০ থেকে এক শ’ টাকায়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আড়ত মালিক জানান, রাজনৈতিক কর্মী, পুলিশ প্রশাসনসহ কথিত মিডিয়াকর্মীদের পর্যন্ত খরচা দিতে হয়। এজন্য টাকা ব্যয় হয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর মাদ্রাসা ছাত্র নাজমুল ও তৃতীয় শ্রেণীর স্কুলছাত্র লিমন বক্স নেটে পোনা আহরণ করছিল। তারা জানায়, লেখাপড়ার ফাঁকে সংসারের বাড়তি যোগানে তারা প্রতিদিন বাগদার রেনু পোনা ধরছে। এমন দৃশ্য সর্বত্র। বাবলাতলা বাজারের মাসুদ হাজীর রয়েছে বিরাট আড়ত। প্রকাশ্যে বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা কেনাবেচা চলছে। একই অবস্থা চাপলী বাজার, লক্ষ্মীর হাট, আলীপুর, মহিপুর, কলাপাড়া, খালগোড়া, খাজুরা, কুয়াকাটা, গঙ্গামতি, ধোলাইর মার্কেট, বটতলা, বানাতিবাজার, চারিপাড়া, ব্যুরোজালিয়া, পাটুয়া, চাকামইয়া, তেগাছিয়া, হাজিপুরসহ সর্বত্র। প্রকাশ্যে পোনা কেনাবেচা চললেও আড়তগুলো বন্ধ করছে না প্রশাসন। কখনও কখনও কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী কিংবা মৎস্য বিভাগ নদীপথে ট্রলারে হানা দিয়ে পোনার হাড়ি নদীতেই অবমুক্ত করে। তবে স্থানীয় আহরণকারীদের দাবি পোনা ধরা বন্ধ হচ্ছে না, তাই নদী কিংবা সাগরে পানির মধ্যে পোনা বাছাই করে বাগদার রেনু রেখে বাকি সব পোনা পানিতে ছেড়ে দেয়ার জন্য সচেতন করা প্রয়োজন। আর নিষেধাজ্ঞার অযুহাতে তারা জীবিকার প্রয়োজনে ধরা পোনার দামও পায় না। লাভবান হচ্ছে একশ্রেণীর আড়ত মালিক। এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানালেন তাদের লোকবল সঙ্কটসহ বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার কথা। এছাড়া প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে, পোড়ানো হচ্ছে সব ধরনের সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল। তবে সচেতন মহলের মতে বাগদার রেনু পোনা আহরণের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনু পোনা নিধনের তা-ব ঠেকাতে না পারলে সাগর কিংবা নদী মাছশূন্য হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
×