ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লঞ্চ দুর্ঘটনা ॥ ২১ বছরে মৃত্যু সাড়ে ৫ হাজার

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

লঞ্চ দুর্ঘটনা ॥ ২১ বছরে মৃত্যু সাড়ে ৫ হাজার

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ দেশে প্রতিবছরই লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলেও ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে ৬৬০টি লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক। আর দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ আছেন আরও প্রায় ১ হাজার ৬শ’ জন। তাদের লাশ আর কখনও পাওয়া যাবে না। এসব লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে চার শতাধিক পরিবার। আর একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে আরও কয়েক শ’ পরিবার। দেশে বর্তমানে ৬ হাজার নৌ-পথ রয়েছে। হিসাবে পুরোটাই রয়েছে একরকম অরক্ষিত। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান জানান, বর্তমানে মাত্র ৫শ’ নৌ-পুলিশ রয়েছে। এর সংখ্যা হওয়া উচিত ২০ হাজার। এই পুলিশকে বিআইডব্লিউটিএ’র কিছু সার্ভে জাহাজ ও স্পিডবোট দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই নৌযানে শৃঙ্খলা রক্ষা সম্ভব নয়। প্রয়োজন আধুনিক যান। মাওয়ার কাছে পদ্মায় গত ৪ আগস্ট পিনাক-৬ ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৪৯ যাত্রীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। সরকারী হিসাবে এখনও নিখোঁজ রয়েছে ৬১ যাত্রী। আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে লঞ্চ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে দুর্ঘটনার আট দিনের মাথায় ১১ আগস্ট উদ্ধার কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তাই লঞ্চটির আর কোন সন্ধান মেলেনি। এই মামলায় পিনাক-৬-এর মালিক আবু বক্কার সিদ্দিক কালু ও পুত্র ওমর ফারুক লিমন এখনও জেল হাজতে রয়েছে। তবে অন্য আসামিরা আর গ্রেফতার হয়নি। এদিকে দুর্ঘটনার এক মাস ১০ দিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি ৬২ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে বিঅআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের পাঁচ কর্মকর্তার অবহেলা ও অনিয়মকে দায়ী করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ পেশ করে। এই রিপোর্ট পেশের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও রিপোর্টের কোন অংশের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পুনর্বহালের চেষ্টা চলছে। এদিকে রবিবার মানিকগঞ্জের দৌলদিয়ার কাছে পদ্মায় ডুবে যাওয়া এমভি মোস্তফা ১৬ ঘণ্টার মাথায় উদ্ধার করা হয়। এটিরও তদন্ত কমিটি হয়েছে। দুর্ঘটনা রোধে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। তারপর আর কিছু হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে বারবার এই একই চিত্র দেখা গেছে। যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়, তখন সরকারের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হলেও তা এক সময় থেমে যায়। কেউই শাস্তি পায় না। এরপর আবার দুর্ঘটনা বাড়ে, মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান যা বললেনÑ এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. খন্দকার শামসুজ্জোহা সোমবার রাতে জনকণ্ঠকে জানান, রবিবার দুর্ঘটনাটি হয়েছে বিপজ্জনক অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে। নদী একবারেই শান্ত ছিল। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ ছিল না। সেখানে এভাবে এতগুলো মানুষ মারা গেল এটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি জানান, দেশে শুষ্ক মৌসুমে এখন ৬ হাজার কিলোমিটার নদী পথ রয়েছে। সেখানে বৈধভাবেই ৩ হাজার ছোট-বড় জাহাজ চলছে। আর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনহীন চলছে আরও কয়েকগুণ। কিন্তু শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো নৌ-পুলিশ নেই। নৌ-পুলিশের জন্য ফাঁড়ি ও থানা প্রয়োজন। প্রয়োজন আধুনিক জাহাজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার ও সিপ্লেন। যে প্লেন প্রয়োজনে পানিতেও নামতে পারে। নয়তো বিশাল নৌ-পথে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন। ৩০/৪০ কিলোমিটার চওড়া নৌ-পথ বিশ্বের আর কোথাও নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ৭০ ভাগ মালামাল ও ৪০ ভাগ যাত্রী নৌ-পথে যাতায়াত করে। সরকারের পরিকল্পনা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ৮০ ভাগ মালামাল ও ৬০ শতাংশ যাত্রী নৌ-পথে পরিবহনের। এই সরকার খননের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ সচল করেছে। নদী খননের পাশাপাশি জীবনহানি ও নৌ-দুর্ঘটনা হ্রাসে জনবলও প্রয়োজন। তার মতে বর্তমানে প্রায় ৫শ’ নৌ-পুলিশ রয়েছে । এই নৌ-পুলিশের সংখ্যা ২০ হাজার হওয়া উচিত। তদন্ত কমিটির সুপারিশের কার্যকারিতা নেই সরকারের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার পর উচ্চপর্যায়ের পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সব ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়নি। কিছু জমা পড়লেও তা প্রকাশ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এসব কমিটির মতে, লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী নৌযানের ত্রুটিপূর্ণ নকশা, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাই এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস না মানা। আবার বেশিরভাগ নৌযানে প্রাণরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও থাকে না। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করা এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। দেখা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তা আর কার্যকর হয়নি। সোমবার পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চেও ধারণক্ষমতার প্রায় চারগুণ অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ৮৫ হলেও তাতে যাত্রী তোলা হয় প্রায় ৩০০। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে পাঁচ শতাধিক তদন্ত হয়েছে। কিন্তু এসব তদন্ত কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়নি। তবে সর্বশেষ পিনাক-৬ দুর্ঘটনায় বিশেষজ্ঞ রাখা হলেও এই রিপোর্টটি যথাযথ কার্যকর হচ্ছে না। এছাড়া লঞ্চের নকশায় পরিবর্তন আনা দরকার। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের নকশায় লঞ্চ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমন-আবহাওয়া, নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ৬৪টি ছোট-বড় লঞ্চ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি, এক হাজার ২০৫ জন মারা যান; আর নিখোঁজ ছিলেন ৫৬ জন। পরের বছরেই মারা যান আরও ৪৮৭ জন। আবার ২০০৮ সালে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০১ জন এবং ২০০৯ সালে ৩০৯ জন। পিনাক-৬-এর আগে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালে। মুন্সীগঞ্জের মেঘনায় নিমজ্জিত হয় “এমভি শরীয়তপুর-১”। এতে ১৪৭ জন যাত্রী প্রাণ হারান। নিখোঁজ ছিলেন আরও অনেকে। গত বছরের ১৫ মে মুন্সীগঞ্জে মেঘনায় এমভি মিরাজ-৪ লঞ্চ ডুবিতে ৫৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সে সময়ও যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ভবিষ্যতে লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তদন্ত কমিটিও একাধিক সুপারিশ করে। কিন্তু সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন আর হয়নি। তদন্ত কমিটির দেয়া সুপারিশে লঞ্চের নকশা অনুমোদন নেয়া, প্রতিটি বন্দরে পরিদর্শক রাখা, চালকদের দক্ষতা পরীক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়। তা ছাড়া লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই বন্ধে লঞ্চ ছাড়ার প্রতিটি স্থানে পরিদর্শক রাখার ওপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চমালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে। বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। তা ছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাঁকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউই শেষ পর্যন্ত শাস্তি পায় না। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিদ্যমান আইনে লঞ্চমালিক ও চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা খুবই কঠিন। আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। এ জন্য আইনের পরিবর্তন হওয়াটাও জরুরী। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে “পিনাক-৬”-এর ক্ষেত্রে। দুর্ঘটনার পরের দিন ৫ আগস্ট লৌহজং থানায় ফৌজদারী আইনে ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর আগে দুর্ঘটনার দিন ৪ আগস্ট মেরিন কোর্টে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয়। এই মামলায় পিনাক-৬-এর মালিক আবু বক্কার সিদ্দিক কালু ও পুত্র ওমর ফারুক লিমন এখন জেল হাজতে রয়েছে। এসব অপমৃত্যুর কি শেষ নেই? স্বজনহারা মানুষের ক্রন্দন-আহাজারিতে ভারি দৌলদিয়ার আকাশ-বাতাস। বাংলাদেশে এভাবে প্রতিবছর লঞ্চডুবিতে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীবহন, চালকদের অদক্ষতা-অনভিজ্ঞতা, লঞ্চের নকশায় সমস্যা, লঞ্চের ফিটনেস তদারকির অভাব ইত্যাদি যেসব কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তা নিয়ে কথা ওঠে কেবল তখনই, যখন কোন লঞ্চডুবিতে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে। অন্য সময় এ বিষয়গুলো দেখভাল করার কেউ থাকে না। এমভি মোস্তফার ধারণক্ষমতা ছিল ১৪০ যাত্রীর। কিন্তু বহন করছিল অতিরিক্ত যাত্রী। ৭০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও নিখোঁজ ৬। কাগজপত্রে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফিটনেস ছিল। কিন্তু বাস্তবে কি ছিল সেটিও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। ২৪ দশমিক ৮মিটার দীর্ঘ, প্রস্ত ৫ দশমিক ৩০ মিটার ও উচ্চতা ১ দশমিক ৭০ মিটার উচ্চতার এই লঞ্চটি আড়াআড়ি যাওয়ার পথে কোন সতর্কতাই অবলম্বন করেনি চালক। ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্যস্ত নৌপথে আড়াআড়ি পারপারে অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন। লঞ্চ দুর্ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে এ দেশে পর্যাপ্ত আইনকানুন নেই। ১৯৭৬ সালের একটি সরকারী অধ্যাদেশ পাঁচ দফায় সংশোধন করার পরেও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা! লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রতিবছর শত শত মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে প্রথমেই কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত। সেই সঙ্গে সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ, লঞ্চের ফিটনেস নিয়মিত তদারকি ও চালক-সহযোগীদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে এই পুরো খাতটির ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।
×